এ জে তপন : করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্থ পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে করোনার কারণে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। করোনার সংক্রমণ বাড়া-কমার মধ্যে দীর্ঘ ১৮ মাস দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শর্তসাপেক্ষে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদান শুরু হয়। যদিও এর আগে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদান করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়েও শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে এসেছেন এবং পরে জমাও নিয়েছেন।
এখন সরকার চিন্তা করছে, ১২ বছর থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে আসার। যাতে করে আগামী দিনে করোনা সংক্রমণ বাড়লেও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ থাকে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা যায়। এ ছাড়া গোটা জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের বিষয়টি তো রয়েছেই।
এসব চিন্তা থেকেই আজ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি। সকাল সাড়ে ৯টায় রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এর পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে ঢাকার আরও আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
সরকার প্রথমে রাজধানীর ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু, যথাযথ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধা না থাকায় ১২টির বদলে আপাতত আটটি বিদ্যালয়ে এ টিকা দেওয়া হবে। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ সুবিধার প্রস্তুতি শেষে দ্রুত ২১ জেলার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। এখন সবাইকে ফাইজারের টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। টিকার সংকটও আছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক এনবি নিউজকে বলেন, ‘ফাইজার ভ্যাকসিনটা খুব টেম্পারেচার সেনসেটিভ। এ ভ্যাকসিনটি আমাদের যে কেন্দ্রে বা বুথে দিতে হয়, সেই কেন্দ্রে বা বুথে প্রচুর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ লাগবে। কারণ, আমরা যে স্কুলগুলো নির্বাচন করতে যাচ্ছি; সেই স্কুলে আমরা একসঙ্গে ২৫টি করে বুথ স্থাপন করতে যাচ্ছি। সোমবার ঢাকা শহরের একটি স্কুল দিয়ে শুরু হবে এ কার্যক্রম। এবং পর্যায়ক্রমে আরও আটটি স্কুলে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। আমরা আশা করব, আগামী মঙ্গলবার থেকে শুরু করার।’
গত ১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের চারটি বিদ্যালয়ের ১২০ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হয়েছিল করোনার টিকা। কোনো সমস্যা না পাওয়ায় সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনার টিকাদান কর্মসূচি। মূলত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও যন্ত্রের সুবিধা না থাকায় সীমিত আকারে এ কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে এ টিকা কার্যক্রম দেশের ২১ জেলায় দেওয়া হবে। তারপর ধীরে ধীরে সারা দেশে এ কার্যক্রম চালানো হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
এ ক্ষেত্রে শহরের বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কী ভাবছে সরকার, তারা কবে টিকা পাবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এনবি নিউজকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘ফাইজারের এ টিকা এভাবে পর্যায়ক্রমে সারা দেশের শিশুদের কাছে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগবে। বলা চলে, আমরা টিকা কার্যক্রমে পিছিয়েই আছি। এখন পর্যন্ত আমরা তো প্রত্যন্ত অঞ্চলের বয়স্ক সবাইকে টিকার আওয়তায় আনতে পারিনি।’
ফাইজারের টিকার সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ করে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সুবিধা থাকার দরকার হবে। ফলে, এ কার্যক্রমের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। আমরা প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সব প্রস্তুতি শেষে আমরা দেশের সব শিশুকে টিকার আওতায় নিয়ে আসব। এর মধ্যে হয়তো শিশুদের জন্য প্রযোজ্য ও যুক্তিযুক্ত অন্য টিকাও চলে আসতে পারে।’
শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘১২ বছরের ঊর্ধ্বের যে শিক্ষার্থীরা আছে, সোমবার থেকে আমরা তাদের টিকা কার্যক্রম শুরু করব। দেশের ২১টি জেলায় শিশুদের এ টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।’
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সুরক্ষা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধন করে টিকা নিতে হয়েছে সবাইকে। সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সীদের নিবন্ধন করার সুযোগ নেই।
তাহলে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীরা টিকার নিবন্ধন কীভাবে করবে- এমন প্রশ্নের জবাবে টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বলেন, ‘প্রথমে স্কুল থেকে একটি তালিকা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের কাছে আসতে হবে। মন্ত্রণালয় সেটা যাচাই-বাছাই করে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে দিয়ে দিবে। তারপর স্কুল কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবক সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করবে। শিশু যেদিন টিকা নিবে, সেদিন সে তাকে রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও জন্ম সনদের ফটোকপি নিয়ে স্কুলে যেতে হবে।’
আপাতত প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার শিক্ষার্থীকে ফাইজারের এ টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরবর্তীতে দিনে ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আমরা নানা পরিকল্পনা করছি। দেশে যেভাবে বা যত পরিমাণে টিকা আসবে, তার ওপর নির্ভর করবে দিনে কতজনকে আমরা এ টিকা দিব। হয়তো সামনে দুই কোম্পানির টিকা পাওয়ার সুযোগ হতে পারে। তখন সেই অনুযায়ী দেওয়া হবে। আর যদি কম পাওয়া যায়, তাহলে সেই অনুযায়ী দেওয়া হবে।’
করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ব্যবস্থাপনা দেখছি, তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের টিকা দিতে বেশ দেরি হতে পারে। কারণ, টিকা সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধা তো আমাদের নেই।’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘যদিও এ সুবিধা পেতে খুব কঠিন কাজ করতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ করতে শূন্য দশমিক ৭৩ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এখন এভাবে সংরক্ষণ করতে চাইলে চীন, আমেরিকায় বা ইউরোপীয় দেশ থেকে এ তাপমাত্রার টিকা কিনতে পারেন। এজন্য টাকা তো আছে। সুতরাং চাইলেই তা সম্ভব।’
এ ছাড়া এ ধরনের ফ্রিজ তৈরির জন্য দেশে কারখানার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে বলে মনে করেন জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সদস্য ডা. নজরুল। তবে তিনি মনে করেন, এসব করতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা।
এদিকে রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এ পর্যন্ত দেশে চার কোটি ২১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৮ জন প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন দুই কোটি ৯২ লাখ ৩৭ হাজার ৮৬৩।
এ ছাড়া এ পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন পাঁচ কোটি ৮৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৪৮ জন। এর মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে নিবন্ধন করেছেন পাঁচ কোটি ৭৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৪২ জন এবং আট লাখ ৫৭ হাজার ৬৬ জন।
আর এখন পর্যন্ত দেশে ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন মোট ছয় লাখ ৮৮ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পূর্ণ করেছেন মোট এক লাখ ৩৮ হাজার ৩৮১ জন।