এনবি নিউজ ডেস্ক : দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রূপায়নে চীনের ঢিলেমির কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে নেপাল। ৬ বছর আগে বেইজিং ও কাঠমান্ডু ট্রান্সপোর্ট ও ট্রানজিট চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ২ বছর পর স্বাক্ষরিত হয় চুক্তির প্রটোকল। কিন্তু এখনো চুক্তি বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। বরং রাসুওয়াগাধি ও তাতোপানি সীমান্তে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করায় চীনের ওপর ক্ষিপ্ত নেপালের ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ, পণ্য পরিবহেণ বাধা দিচ্ছে চীন। সে দেশের পরিবহণ ব্যবসায়ীরা সীমান্তবর্তী ২৫ কিমি সড়কে পণ্য পরিবহনের মাশুল চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চুক্তিবিরোধী আচরণের কোনো ব্যাখ্যাও নেই চীনের কাছে। নেপালিরা এখন চাইছেন, আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলুক চীন। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেপালি ব্যবসায়ীরা হয়রানি থেকেও মুক্তি চাইছেন।
বেইজিংয়ের সঙ্গে কাঠমান্ডুর প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী তিয়ানজিন, শেনজেন, লিয়ানিউঙ্গাং ও ঝানজিয়াং সমুদ্রবন্দর এবং লানঝো, লাসা ও শিগাতসে স্থল বন্দরের মাধ্যমে চীনের ভিতর দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করবে নেপাল। দুই দেশের ৬টি ডেডিকেটেড ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়েও মাল আনা-নেওয়ার সুবিধাও পাবে তারা। কিন্তু গত বছর কাঠমান্ডু পোস্ট-কে নেপালের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্য সচিব পুরুষোত্তম ওঝা বলেন, চুক্তির ৫ বছর পরেও নেপাল চীনের মধ্যে দিয়ে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে কোনো কনসাইনমেন্ট আনতে পারেনি। শুধুমাত্র রাসুওয়াগাধি ও কেরুং সীমান্ত খোলা। তবে সেখানেও বানিজ্যের বহর অনেক কমে গিয়েছে।
নেপালের ফ্রেট ফরওয়াডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রকাশ কার্কি জানিয়েছেন, তারা এখন ভারতের কলকাতা বন্দর দিয়েই পণ্য আমদানি করছেন।
ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানির অসুবিধার কারণে ২০১৫ সালে চীনের সঙ্গে চুক্তি করেছিল নেপাল; কিন্তু এখন বুঝতে পারছে তাদের উত্তরের চীন থেকে দক্ষিণে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করাই সুবিধাজনক। চীনের সঙ্গে তিক্ত ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাই তাদের ভারতমুখী করে তুলেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির মন্ত্রিসভায় বাণিজ্যমন্ত্রী লেখ রাজ ভাটিয়া কাঠমান্ডুর বিশিষ্ট সাংবাদিক হরিবংশ ঝাকে বলেছেন, চীনের সঙ্গে আদৌ ব্যবসায়িক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা উচিত কিনা সেটা পুনর্বিবেচনার সময় হয়েছে। অতিমারির অজুহাত দেখিয়ে চীন উতসবের মরশুমে পোশাক, জুতো, প্রসাধন সামগ্রী, বৈদ্যুতিক ও শিল্পের কাঁচামাল ভর্তি দুই হাজারেরও বেশি কন্টেনার আনতে দেয়নি নেপালকে। ন্যাশনাল ট্রেডার্স ফেডারেশনের সভাপতি নরেশ কাটুওয়াল জানিয়েছেন, নেপালি ব্যবসায়ীদের গত বছর ভিসাই দেয়নি চীন। এমনকি বাড়তি পয়সা খরচ করে কিছু চীনা সামগ্রীও তাদের কলকাতা বন্দর দিয়ে ঘুরপথে আনতে হয়েছে।
গরিব প্রতিবেশীর সঙ্গে চীনের এ ধরনের আচরণের কোনো ব্যাখ্যা একটাই- ওলির সরকারের পতনের আগাম গন্ধ পেয়েছিল বেইজিং। শর্মা ওলির কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট) এবং প্রচণ্ডর কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (মাওইস্ট সেন্টার) মধ্যে সংযোগ ঘটাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছিল চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। সেটা ব্যর্থ হয়। পায়ের নিচ থেকে পাটি সরতেই প্রচণ্ড সমর্থন তুলে নেয় ওলির ওপর থেকে। গত জুলাইতে শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে নেপালি কংগ্রেস সরকার গঠন করে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, চীনের বহুদিনের পরিকল্পনা মাওবাদীদের মদদ জুগিয়ে নেপালে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার। বেজিং জানে, নেপালের সঙ্গে ভারতের সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই সম্পর্ককে নষ্ট করে নেপালকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতেই মাওবাদীদের সাহায্য নিয়ে চলেছে চীন। কিন্তু নেপালের মানুষই চীনা ষড়যন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
মেড ইন চায়না মানেই জিনিস টেকসই নয়। ধাক্কা খেয়ে নেপাল এটাও এখন ভালোই, বুঝতে পারেছে। নেপাল এয়ারলাইন্সের চীনের তৈরি দুটি এমএ ৬০ এবং ৪টি ওয়াই ১২-ই বিমান আছে। কিন্তু নিম্নমানের প্রযুক্তিতে নির্মিত বিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহনই দায় হয়ে পড়েছে। বেচতে চাইলেও খরিদ্দার নেই চীনা বিমানের। নেপালি মুদ্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন ঋণে আনা বিমান হাতি পোষার সমান হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের মার্চে একটি চীনা বিমানের ইঞ্জিনে বিদ্যুত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় ল্যান্ডিংয়ে বিপত্ত ঘটে। অল্পের জন্য যাত্রী ও ক্রু মেম্বাররা প্রাণে বাঁচলেও বিমানটি অচল। নেপাল এয়ারলাইন্স বারবার অভিযোগ করলেও চীনা কর্তৃপক্ষ তাতে সাড়া দেয়নি। বরং নতুন করে বিমান বেচার প্রলোভন দেখিয়ে চলেছে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পও ধুঁকছে নেপালে। ২০১৭ সালে নেপাল বিআরআই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু এখনো কাজ শুরু হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) অধীনে পরিকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প নেপালে বিআরআইকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালে বিআরআই বা চীনের অন্যান্য বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন স্থানীয় মানুষরা। অনেকেই মনে করছেন পরিকাঠামো উন্নয়নের লোভ দেখিয়ে নেপালে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে চায় বেজিং।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের চুক্তি বাতিল করা থেকে শিক্ষা নিয়েছে নেপাল। নেপালের এই জনপ্রিয় পত্রিকাটির মতে, বিআরআইয়ের নামে ঋণের ফাঁদে পা দিতে চায়না কাঠমান্ডু।
নেপালের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী রাজেন্দ্র মাহতো কাঠমান্ডু পোস্টকে বলেছেন, বিআরআই প্রকল্পে নেপালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ কতোটা সুরক্ষিত থাকবে সেটা বিচার করা জরুরি। নেপালের মাটিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছুতেই ব্যবহার করতে দেওয়া যায়না।
বিআরআই প্রকল্পের অধীনে বুধি গন্ডকী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেরুং-কাঠমান্ডু রেলপ্রকল্পের ব্যাপক প্রভাব নেতিবাচক পড়বে পরিবেশের ওপর। এ বিষয়গুলোও ভাবাচ্ছে নেপালিদের।
নেপালের উন্নয়নে বহুকাল ধরে সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৫১ সালে চার দফা সহায়তা কর্মসূচিতে উপকৃত হয় হিমালয়ান রাষ্ট্রটি। ২০১৭ সালে এমসিসি চুক্তিতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ৩০০ কিমি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন এবং ৩০০ কিমি সড়ক মেরামতির জন্য এই অনুদান।
তথ্যমন্ত্রী জ্ঞানেন্দ্র বাহাদুর কার্কি জানিয়েছেন, ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদানের প্রস্তাব সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুরও এমসিসি প্রকল্প রূপায়নে রাজি। এমনকী, মাওবাদী নেতা প্রচন্ড-ও যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান দিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, আমাদের পরিকাঠামো উন্নয়নে সহায়তার জন্য যে অনুদান আসছে খুশি হয়ে সেটা গ্রহণ করা উচিত। ফলে বিফলে যেতে বসেছে নেপালে চীনের আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্র।
এ টি