সাগর হোসেন : সৎ মা ও শিশু ভাই বোনকে যখন আবাদ কোপাচ্ছিল তখন তারা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল। তাদের চিৎকারে আশেপাশের লোকজনও এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আবাদ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। এরপর সে ফের হামলে পড়ে মা ও ভাই-বোনের ওপর। ইচ্ছেমতো তাদের কোপায়। পরে তোষকে আগুন ধরিয়ে তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই পুলিশ ও এলাকাবাসী দরজা ভেঙে তাকে আটক করে। সিলেটের শাহপরান (রহ.) থানা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায় ৩ খুনের ঘাতক আবাদ হোসেন।
নিহতরা হলেন- সিলেট শহরতলীর বিআইডিসি এলাকার মীর মহল্লার আব্দাল হোসেন খান বুলবুলের স্ত্রী রুবিয়া বেগম (৩০), তার মেয়ে মাহা (৯) এবং ছেলে তাহসান (৭)। রুবিয়া ও তার মেয়ে মাহার ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় এবং তাহসান শুক্রবার ভোর ৪টায় এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
বিআইডিসি এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন আব্দাল হোসেন। তার মূল বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে। আব্দালের প্রথম স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বিয়ানীবাজারে বসবাস করেন। বিআইডিসি’র গলির মুখে আব্দালের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘খান ভ্যারাইটিজ স্টোর’। দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার পক্ষের সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন মীর মহল্লার একটি ভাড়া বাসায়। অসুস্থ থাকায় আব্দাল কয়েক মাস আগে তার প্রথমপক্ষের বড় সন্তান আবাদ হোসেন খানকে বিয়ানীবাজার থেকে সিলেটের বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর থেকে আবাদ হোসেন পিতার সঙ্গে দোকানেই সময় দিচ্ছিল। আর থাকতো মীর মহল্লার বাসাতেই।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আবাদ জানায়- ‘রাগের মাথায় একসঙ্গে সে ৩ জনকে খুন করেছে। কারণ- সৎমা রুবিয়া বেগম সব সময় তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো। সময়মতো খাবার দিতো না। কাপড়ও ধুয়ে দিতো না। সে সন্তানের মতো আচরণ করতো না। বরং তাকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়েই সে ৩ জনকে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আবাদ তার পিতার কথায় সিলেটের মীর মহল্লার বাসায় আসার পর সৎমায়ের সঙ্গে নানা কারণে বিরোধ দেখা দেয়। সৎমাও তাকে প্রায় সময় শাসাতো। আবাদের আচরণে সৎমা ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিষয়টি তিনি জানিয়েছেন স্বামী আব্দালসহ আশেপাশের মানুষদের। আশঙ্কা করেছিলেন- সৎপুত্র আবাদ তাকে হত্যা করতে পারে। এমন আশঙ্কা তিনি জানালেও কেউ গুরুত্ব দেননি। বৃহস্পতিবার রাতে পিতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ছিল আবাদ। দোকানে পিতাকে রেখেই সে বাসায় চলে আসে। রাত তখন ১২টা। এমন সময় বাসার ভেতর থেকে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনতে পান স্থানীয়রা। চিৎকার শুনে তারা এগিয়ে গেলেও বাসার দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় খোলা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি জানানো হয় শাহপরান থানা পুলিশকে। খবর পেয়ে পুলিশের টহলদল সেখানে পৌঁছে। তারা গিয়ে দরোজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় পুলিশ রক্তাক্ত দা পাশে রেখে ঘরের এক কোণায় বসে থাকতে দেখে আবাদ হোসেন খানকে। আর বিছানায় পড়ে আছে সৎমা রুবিয়া বেগম ও বোন মাহার দেহ। উপুর্যুপরি কোপানোর ফলে তাদের দেহ রক্তাক্ত। গোটা ঘরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল রক্তের দাগ। এ সময় পাশেই ছিল তানসানের দেহ। তার শরীরে কোপ দেয়া হলেও সে তখনো জীবিত ছিল। আর রুবিয়া ও মাহার নিথর দেহ পড়েছিল খাটের ওপর।
পুলিশ ও এলাকার মানুষ রুবিয়া ও ৯ বছরের বোন মাহার মরদেহ উদ্ধার করে। আর গুরুতর আহত অবস্থান ৫ বছরের শিশু তানসানকে উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় ঘরের ভেতর থেকে রক্তাক্ত দা, ছোরা ও খুন্তিসহ আটক করে ঘাতক আবাদকে। তাকে সিলেটের শাহপরান থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আবাদ ধারালো দা, খুন্তি ও ছোরা দিয়ে তাদের কোপানোর পর বিছানার তোষকেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল ওই ৩ জনের লাশ পুড়িয়ে ফেলা। কিন্তু তোষকে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যায়নি। আগুন ধরার কারণে গোটা ঘরই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।
নিহত রুবিয়া বেগমের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন- সৎমা রুবিয়া বেগমকে দুই চোখে দেখতো পারতো না ঘাতক আবাদ হোসেন। বিয়ানীবাজারে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তির একাংশের দাবিদার ছিল রুবিয়া ও তার সন্তানরা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক বিরোধ চলছে। এই বিরোধ মেটাতে পিতা আব্দাল হোসেন বড় ছেলে আবাদকে বিয়ানীবাজার থেকে সিলেটের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সে ওখানে আসার পর থেকে বিরোধ আরো চাঙ্গা হয়।
তারা বলেন, আগেও কয়েকদিন আবাদ তার সৎমাকে মারতে তেড়ে গিয়েছিল। প্রায় সময় গালিগালাজও করতো। এসব নিয়ে পিতা আব্দালও আবাদকে শাসাতেন। পিতা শাসালে সে চুপ হয়ে যেতো। কিছু বলতো না। কিন্তু যখন পিতা বাসায় থাকতো না তখন সে সৎমাকে গালিগালাজ করতো।
এদিকে, গ্রেপ্তারের পর আবাদকে শাহপরান (রহ.) থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। শাহপরান থানার ওসি সৈয়দ আনিসুর রহমান জানিয়েছেন- জিজ্ঞাসাবাদে আবাদ হোসেন খান খুনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। পারিবারিক বিরোধের কারণেই খুন করা হয়েছে বলে তারা জানতে পারেন। তিনি বলেন, আবাদ নিজেই তার সৎমা রুবিয়া, বোন মাহা ও ভাই তানসানের ওপর হামলা চালায়। পরে তারা নিস্তেজ হয়ে পড়লে সে আগুন দিয়ে লাশ পুড়িয়ে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিক পুলিশ গিয়ে দরোজা ভেঙে ফেলায় আগুন ছড়ায়নি।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় শাহপরান থানায় আটক আবাদ হোসেন খানকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি চলছে। আবাদকে আজ সিলেটের আদালতে হাজির করা হবে বলে জানান তিনি।
সাহো
প্রধান নির্বাহী - আরেফিন শাকিল, অফিসঃ নদী বাংলা টাওয়ার, শহীদ বুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ফোনঃ 01303-166473