এনব নিউজ : মাঘের শুরুতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শীতের দাপট আরও বেড়েছে। পারদ নেমেছে ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশে এ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। শুক্রবার সকাল ৬টায় শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া কার্যালয় তীব্র শৈত্যপ্রবাহের এ তাপমাত্রা রেকর্ড করে। কয়েকদিন ধরেই এ জেলার উপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বইছে এবং যা আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
শ্রীমঙ্গলের মতো শীতের দাপট (মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ) এদিন ছিল তেঁতুলিয়া (৬.৫ ডিগ্রি), চুয়াডাঙ্গা (৭.৪), পাবনার ঈশ্বরদী (৭.৭) ও নওগাঁর বদলগাছীতে (৭.৯)। এ ছাড়া রাজশাহী, যশোর, বরিশাল, ভোলা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, রাঙ্গামাটি ও ফেনীতে বইছে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ (৮-১০ ডিগ্রি)। হাড়কাঁপানো এ শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এসব এলাকার জনজীবন। বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ ও চা বাগানের শ্রমিকেরা। পাশাপাশি বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরাও পড়েছেন বিপদে।
এর আগে এ মৌসুমে ১০ জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ দশমিক ৯ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়েছিল। আর এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি। সেদিন তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা সব রেকর্ড ভেঙে নেমে এসেছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
শুক্রবার গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা টেকনাফে ১৯.২ এবং ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৪.০ ও সর্বনিম্ন ১২.৩ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
শ্রীমঙ্গল : শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মুজিবুর রহমান জানান, আজ (শুক্রবার) সকাল ৬টায় ও ৯টায় ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এটি আজ দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।
মৌলভীবাজার জেলা আবহাওয়া কার্যালয়ের কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান জানান, কয়েকদিন আগেও কুয়াশা ছিল। সেই কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর কয়েকদিন ধরে সূর্যের দেখা মিললেও জেলাজুড়ে হিমেল হাওয়া বইছে। এতে কনকনে ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি আরও কয়েকদিন চলবে।
কাঁপন ধরানো এ শীতে বয়স্ক-শিশুরা ভুগছে বেশি। শ্রীমঙ্গলের সবুজবাগ এলাকার ষাটোর্ধ্ব সুমতি মালাকার বলেন, এত শীত অনেকদিন দেখিনি। সকালে উঠে পানিতে হাত দেওয়া যায় না। চলাফেরা কাজকর্ম করা অনেক কষ্ট। কৃষক সুবোধ মালাকার বলেন, সকালে মাঠে এসে কাজ করতে পারি না আর। হাত দিয়ে যাই ধরি পড়ে যায়।
শীতবস্ত্রের অভাবে চা বাগান ও বস্তি এলাকার লোকজন সকালের দিকে গাছের পাতা ও খড়কুটো কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। সন্ধ্যা নামতেই ঘরে ফিরছেন লোকজন। যদিও শীত নিবারণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কম্বল ও শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, এ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪ হাজার ৪০০টি কম্বল বিভিন্ন ইউনিয়ন ও চা বাগানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সামনে আরও বিতরণ করা হবে।
১৯৬৮ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ১৯৬৬ সালের ২৯ জানুয়ারি দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯৫ সালের ৪ জানুয়ারি, ২০০৭ সালের ১৭ জানুয়ারি এবং ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মৌলভীবাজার : কনকনে তীব্র শীতে কাঁপছে হাওড় অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার হাওড় পারের বাসিন্দারা। সরকারিভাবে জেলায় শীতার্তদের জন্য কম্বল আসলেও পর্যাপ্ত পাননি জেলার হাকালুকি, হাওড় কাউয়াদিঘী, হাইল হাওড়সহ ছোট-বড় ৮টি হাওড় পাড়ের বসবাসরত জেলে, দুস্থ, ছিন্নমূল ও শীতার্ত মানুষ। হাওড় তিরের বাসিন্দারা শীতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হাওড় পারের বোরো চাষিরাও শীতে অনেকটা বিপর্যস্ত। জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ অফিস সূত্রে জানা যায়, এবারের শীতে জেলায় কম্বল এসেছে ৩৫ হাজার ২৮০ পিস। এর মধ্য থেকে জেলা প্রশাসক মহোদয় বিতরণ করেছেন ৩ হাজার ৬শ।
রাজনগর উপজেলার হাওড় কাউয়াদিঘী পাড়ের সামছুল মিয়া, শহিদ মিয়া ও নেওয়া বেগম বলেন, কয়েক দিন ধরে খুব বেশি শীত। আমরা দিনমজুর মানুষ টাকার অভাবে শীতের কাপড়ও কিনতে পারছি না। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কোনোরকম খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছি।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নকুল চন্দ্র দাশ বলেন, আমার ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম হাওড় সংলগ্ন। দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও তুলনামূলক অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে বেশি। অথচ এ শীতে আমার ইউনিয়নে সরকারিভাবে মাত্র ৩শ পিস কম্বল দেওয়া হয়েছে। বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান বলেন, এবার মাত্র ৪শ কম্বল পেয়েছি। ৪ হাজার দিলেও আমার ইউনিয়নের চাহিদা মিটবে না। জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাদু মিয়া বলেন, প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কাছে সরকারি বরাদ্দের কম্বল পৌঁছানো হয়েছে। চেয়ারম্যানরা কিভাবে বিতরণ করছেন বিষয়টি আমরা অবগত নই।
শেরপুর : শীতের দাপট আরও বেড়ে যাওয়ায় কাবু হয়ে পড়েছে সীমান্তবর্তী জেলা শেরপুরের মানুষ। পাঁচ উপজেলায় তিন সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মাঠ নেমে কৃষি কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সকালে ও রাতে ঘন কুয়শার কারণে সামান্য দূরের বস্তুও ঝাঁপসা দেখা যাচ্ছে। ফলে সড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। শ্রমজীবী গরিব মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও : ঠকঠক করে কাঁপছেন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার জীবনপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধরা। মাঘের ঠান্ডায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাদের উপার্জন। ভিক্ষাবৃত্তিই তাদের একমাত্র পেশা। ষাট বছর বয়সি মোমেনার স্বামী ১০-১১ বছর আগে মারা গেছে। চালচুলা কিছুই রেখে যায়নি। গুচ্ছ গ্রামে থাকেন তিনি। সকাল হলেই এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে খাবার জোগাড় করেন এই অসহায় নারী। মোমেনা চোখ মুছে বলেন, চেয়ে চেয়ে খাই বা। এত ঠান্ডা! মোর একখান কম্বল নাই। খড়কুটো জ্বালিয়ে রাত কাটাই। একই গ্রামের মরিয়ম আক্ষেপের সুরে বলেন, ভোট আসিলে সবাই দেখা হয়, ভোট হইলেই কেউ নাই!
বৃহস্পতিবার মরিয়ম, মোমেনাসহ শতাধিক হতদরিদ্র শীতার্ত নারী-পুরুষ জেলার হরিপুর উপজেলা পরিষদে কম্বলের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিকাল পর্যন্ত থেকেই তাদের জোটেনি কোনো শীতবস্ত্র। উপজেলার কুশগাঁও গ্রামের আবু বক্কর অভিযোগ করে বলেন, স্যার (ইউএনও) হামার নাম লিখে নিল। কিন্তু কম্বল দেল না।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একেএম শরীফুল ইসলাম বলেন, সোমবার তাদের কম্বল দেওয়া হবে। নেকমরদ ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, শতকরা ১০ ভাগ হতদরিদ্র শীতার্তদের হাতে পৌঁছেনি কোনোরকম শীতবস্ত্র। তিনি জানান, শীতবস্ত্রের অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন এসব মানুষ। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনতোষ কুমার দে বলেন, সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ও সচ্ছল ব্যক্তিদের অসহায় নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
এমকেপি নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জরিপে জানা গেছে, এ জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষের বসবাস। এরমধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ হতদরিদ্র। জেলায় ২০-২৫টি এনজিও কাজ করছে। তবে আত্মমানবতার সেবায় এখনো পর্যন্ত কেউ এগিয়ে আসেনি জানিয়েছেন সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার শরিফুল ইসলাম।
রাজনৈতিক দলগুলোও এবার তেমনভাবে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ায়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভারতে অবস্থান করছেন। সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায় বলেন, তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে কিছু কম্বল বিতরণ করেন। বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মামুন উর রশিদ বলেন, তারা স্থানীয়ভাবে সাড়ে তিনশ কম্বল বিতরণ করেন।
যুবলীগ কিছু কম্বল বিতরণ করে বলে জানান, জেলা সাধারণ সম্পাদক সমীর দত্ত। কেন্দ্রীয় মহিলা লীগের সদস্য ও ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন নতুন বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা হিসাবে হাসপাতাল, শ্রমজীবী ও ভবঘুরে দেড় হাজার মানুষকে শীতবস্ত্র প্রদান করেন।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠাকুরগাঁও জেলায় ২৮ হাজার কম্বল বরাদ্দ মিলেছে। তা জনপ্রতিনিধি এবং ইউএনওদের মাধ্যমে বিলি করা হয়েছে। আরও ৩০ হাজার কম্বল ও ২০ লাখ টাকা চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
এ টি
প্রধান নির্বাহী - আরেফিন শাকিল, অফিসঃ নদী বাংলা টাওয়ার, শহীদ বুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ফোনঃ 01303-166473