সাগর হোসেন : শিক্ষা বিভাগে আগামী আড়াই মাসে প্রায় ১১ লাখ জনবলকে টিকা দেওয়া হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং এই বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আছেন এই তালিকায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোদমে চালুর আগে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে সরকার এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
এ লক্ষ্যে প্রায় ১২ লাখ টিকা শিক্ষা বিভাগের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষণের প্রস্তাব এসেছে। শনিবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদিকে রোজার মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার ঘোষণায় অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু অভিভাবক এনবি নিউজকে টেলিফোনে জানিয়েছেন, অভিভাবকদের সমস্যার কথা বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী কয়েক বছর আগে গোটা রমজান মাসই স্কুলে ছুটি রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। শহরাঞ্চলে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকদের স্কুলে যেতে হয়।
করোনা পরিস্থিতির কারণে এ ধরনের চর্চা আরও বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে এই মাসে খোলা রাখা হলে অভিভাবকদের অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাতে হবে। তবে অভিভাবকদের আরেকটি অংশ বলেছেন, এক বছর ধরে শিশুরা ঘরে অবরুদ্ধ থাকায় হাঁপিয়ে উঠেছে। স্কুল ছুটি থাকলেও কিশোর-কিশোরীদের ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না।
অলস বসে থাকায় কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বেড়েছে। তারা যেহেতু বাইরে যাচ্ছেই, তাই প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক হয়েছে। তাছাড়া স্কুল খোলার ঘোষণায় অনেক শিক্ষার্থী খুশিই হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এ প্রসঙ্গে রোববার এনবি নিউজকে বলেন, ছেলেমেয়েরা এক বছর ধরে লেখাপড়া করতে পারেনি। তারা শ্রেণিকক্ষে ফিরতে উদগ্রীব। তাছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকেই সপ্তাহে একদিন যেতে হচ্ছে স্কুলে। নবম ও একাদশ শ্রেণির কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে দুদিন আর পরীক্ষার্থীদের ৫-৬ দিন যেতে হবে।
করোনা সংক্রমণের বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এতে ক্ষতির কিছু নেই। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সামনে রেখে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় অংশকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। এজন্য লম্বা সময় হাতে রেখে ছুটির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সংক্রান্ত যে গাইডলাইন ইতঃপূর্বে পাঠানো হয়েছে, সেটি অনুযায়ীই ক্লাস নেওয়া হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি হলে শিফট করে ক্লাস নেওয়া হবে। যেহেতু প্রথম থেকে চতুর্থ এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একদিন যাবে স্কুলে, তাই এই শিফটিং সহজ হবে।
শিক্ষকরা দৈনিকই স্কুল-মাদ্রাসায় যাবেন। আর যাবে পঞ্চম, দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। তিন ফুট দূরত্বে বেঞ্চগুলো স্থাপন করা হবে। পাঁচ ফুটের কম দৈর্ঘ্যরে বেঞ্চে একজন শিক্ষার্থী এবং পাঁচ থেকে সাত ফুট দৈর্ঘ্যরে বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পারবে।
এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালুর প্রথম দুই মাসের মধ্যে এমন কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা বা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা যাবে না, যাতে শিক্ষার্থীর ওপর চাপ তৈরি হতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন এনবি নিউজকে বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার দিকটি নিশ্চিত করেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। তাছাড়া আমরা সবাইকে একদিনে স্কুলে আনছি না। ইতঃপূর্বে প্রকাশিত গাইডলাইনই আমরা অনুসরণ করছি। তাতে স্কুল-মাদ্রাসা পরিচালনার নির্দেশনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
.তিনি বলেন, এরপরও পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োজনে গাইডলাইন হালনাগাদ করে আরও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম গোলাম ফারুক এনবি নিউজকে বলেন, সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিল থেকে নির্বাহ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর কোনো ফি আরোপ করা যাবে না।
সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনাকে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কোনো দেশে সংক্রমণের হার টানা ৪ সপ্তাহ ৫ শতাংশের নিচে থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াসহ স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড শুরু করা যেতে পারে।
তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ৫ শতাংশের নিচে সংক্রমণের হার টানা ৮ সপ্তাহ পেরিয়েছে। আর ৬ সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার ৩ শতাংশ বা এর নিচে। সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়। তবে যেহেতু টিকা এসে গেছে, তাই সরকারের নীতি অনুযায়ী প্রাপ্য নাগরিকদের টিকা নিশ্চিত করা উত্তম।
সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অপরাধ চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ছোটখাটো কিশোর অপরাধের সংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে তারা লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এতে ইতিবাচক ফল আসতে পারে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে এনবি নিউজকে জানান, শিক্ষা বিভাগের জন্য ১২ লাখ টিকা সংরক্ষণ রাখার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারী মিলে প্রায় ১১ লাখ টিকা প্রয়োজন হতে পারে। এখন থেকে ১৭ মে পর্যন্ত আড়াই মাসে এ টিকা দেওয়া হবে।
এই ১১ লাখের মধ্যে ৫ লাখ মাধ্যমিক স্তরের সরকারি ও বেসরকারি এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী। প্রাথমিক স্তরেও একই ধরনের ৫ লাখ জনবলকে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে রোববার পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষককে টিকা দেওয়া শেষ হয়েছে। বাকিরা উচ্চশিক্ষা স্তরের। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১৮ বছর বয়স বিবেচনার কথা এসেছে। এজন্যই জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর চাওয়া হয়েছে।
মাউশির মহাপরিচালক বলেন, গাইডলাইন অনুযায়ী আমরা প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এবং কর্মকর্তাকে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ ব্যবস্থা নেবে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে আলাদা টিকা পাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান এনবি নিউজকে বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২০ আবাসিক হলে ১ লাখ ৩২ থেকে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ হাজার ৬শ এবং বেসরকারিতে ১৬ হাজার ৮৭ জন শিক্ষক আছেন। এর বাইরে ২ লাখের কিছু বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এদের অনেকে সাধারণ কোটায় টিকা নিয়েছেন। ৪০ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের জন্য কেবল বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন হবে। আমরা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছি।
সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর চেয়েছি। সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ইমেইলে তারা পাঠাতে পারেন। এর অনুলিপি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিতে পাঠাবেন তারা। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষক টিকা নিয়েছেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও টিকা নিচ্ছেন।
প্রধান নির্বাহী - আরেফিন শাকিল, অফিসঃ নদী বাংলা টাওয়ার, শহীদ বুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ফোনঃ 01303-166473