আসাদুজ্জামান তপন : গুরুতর ফৌজদারি অপরাধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত ৯ বছরে পুলিশ বাহিনীর ১১৬ সদস্যের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও ঢাকার বিভিন্ন আদালতে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মাদক, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।
ঢাকা মহানগরের সিএমএম, ঢাকার সিজেএম আদালত, ঢাকার মহানগর ও ঢাকার দায়রা জজ আদালত এবং ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও আইন কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়া খুবই শঙ্কার। তাই যাঁরা ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মামলার তদন্ত হতে হবে নিরপেক্ষ। তা ছাড়া ভবিষ্যতে যাতে তাঁরা অপরাধে জড়িত না হতে পারেন, সে জন্য কঠোর প্রশাসনিক নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া ১১৬ জনের মধ্যে ডিএমপির উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার কর্মকর্তা আছেন ১৯ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মর্যাদার ১৬ জন। এ ছাড়া ৭৪ জন পুলিশ কনস্টেবল, ৫ জন নায়েক এবং ১ জন সার্জেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১১৬ জনের মধ্যে মাদক মামলার আসামি ২৮ জন। এর বাইরে ধর্ষণ (৯ জন), ছিনতাই (৬ জন), পারিবারিক বিরোধ ও নারী নির্যাতন (১৮ জন), পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন (৫ জন), হত্যাকাণ্ড (৩ জন), চাঁদাবাজি (১২ জন), অপহরণ (৪ জন), অস্ত্র (৫ জন), ডাকাতি (৫ জন), চুরি (৫ জন), প্রতারণা (৬ জন), সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ড (১ জন), সড়কে মৃত্যু ঘটানো (১ জন), হত্যাচেষ্টার (১ জন) অভিযোগে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। তবে ছয়জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় অপরাধের ধরন জানা যায়নি।
ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম টেলিফোনে এনবি নিউজকে বলেন, ডিএমপির কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যদি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর ছাড় নেই। তথ্য-প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে ওই সব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আগেও ফৌজদারি মামলা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।
পুলিশ ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তথ্য বলছে, ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছর (২০২০) ২৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি মামলা (৩৭ জনের বিরুদ্ধে) হয় ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালে ১২ জন, ২০১৭ সালে ৬ জন, ২০১৬ সালে ২ জন, ২০১৫ সালে ১১ জন, ২০১৪ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ২ জন, ২০১২ সালে ৬ জন এবং ২০১১ সালে ১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা এনবি নিউজকে বলেন, যাঁরা ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় মামলা করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের নামে ফৌজদারি মামলা দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মাদক ব্যবসার অভিযোগ
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৯ বছরে পুলিশের ২৮ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে থানায় মামলা হয়েছে। আসামির তালিকায় আছেন পুলিশের চার এসআই, তিনজন এএসআই। বাকি ২১ জন কনস্টেবল। সর্বশেষ ১৪ জানুয়ারি ফেনসিডিল ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে মতিঝিল থেকে গ্রেপ্তার হন কনস্টেবল শুয়েয খান। তাঁর কাছে ১৫ বোতল ফেনসিডিল পাওয়া যায়। পরে গ্রেপ্তার হন তাঁর সহযোগী কনস্টেবল আসাদুজ্জামান। দুজনই এখন কারাগারে।
নথিপত্র বলছে, ২০১৯ সালে ডিএমপির ১১ সদস্যের বিরুদ্ধে মাদক মামলা হয়। এঁদের মধ্যে নয়জন কনস্টেবল, একজন এসআই ও আরেকজন এএসআই। আগের বছর দুজন কনস্টেবল, ২০১৭ সালে একজন এসআই, ২০১৬ সালে দুজন এসআই এবং ২০১৪ সালে দুজন কনস্টেবলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। এঁদের কাছ থেকে হেরোইন ও ইয়াবা জব্দ করে পুলিশ।
ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর (পিপি) আবদুল্লাহ আবু এনবি নিউজকে বলেন, অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাঁদের হাতে, তাঁদের মধ্যে কেউ যদি মাদক, ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়েন, সেটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এসব অপরাধে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ সব সময় সচেষ্ট থাকবে।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ
মাদক ছাড়াও ডিএমপির ২৮ সদস্যের নামে পারিবারিক বিরোধ, নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে চারজন এসআই। বাকি ২৪ জন কনস্টেবল। মামলার তথ্য বলছে, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের অভিযোগে ১৫ পুলিশের নামে আদালতে মামলা হয়। আর ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা হয় ১০ জনের নামে।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে গত বছরের ১৮ অক্টোবর ১২ বছর বয়সী এক কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় এএসআই আবদুল করিম চৌধুরী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কামরাঙ্গীরচর থানা-পুলিশের প্রতিবেদন বলছে, কিশোরী ধর্ষণের সঙ্গে আবদুল করিমের জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি মাহমুদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর আদালতে যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভিযোগে পুলিশের নামে করা কয়েকটি মামলা বিচারাধীন। এ ধরনের অপরাধে পুলিশের জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দুঃখজনক।
নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ইশতিয়াক হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে পল্লবী থানায় ফেলে নির্যাতনের অভিযোগের মামলায় তিন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার আদালত। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এ রায় দেওয়া হয়।
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের মামলায় পাঁচ সদস্যের নামে মামলা হয়।
হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ নির্যাতনের মামলা ছাড়া বিগত ৯ বছরে অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশের ২৭ জন সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়। এঁদের মধ্যে ৮ জন পুলিশের এসআই, ৭ জন এএসআই, ১০ জন পুলিশ কনস্টেবল এবং ২ জন নায়েক। মামলার তথ্য বলছে, এসব পুলিশের বিরুদ্ধে ডিবি ও র্যাব পরিচয়ে অপহরণ, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়।
ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির অভিযোগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর এএসআই শহীদ শেখসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা ডাকাতিসহ নানা অপরাধ করে আসছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান এনবি নিউজকে বলেন, পুলিশ সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া, আরও স্বচ্ছতা আনা জরুরি।
সাজা কম
৯ বছরের তথ্য বলছে, ১১৬ জনের মধ্যে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের মামলায় তিন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আর ডাকাতির মামলায় এক পুলিশ সদস্যের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়। দণ্ডিত পাঁচ আসামি র্যাবে কর্মরত ছিলেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক। আসামিরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ডাকাতির মতো ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন।
এ ছাড়া চারটি মামলায় খালাস পেয়েছেন চার পুলিশ সদস্য। দুটি মামলার তদন্ত স্থগিত রয়েছে। আর বিচারাধীন রয়েছে ৮১টি মামলা। তবে ২৫টি মামলার তথ্য জানা যায়নি।
পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এনবি নিউজকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হয়েও যাঁরা খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত, তাঁদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে এবং যেগুলো বিচারাধীন আছে, সেসব মামলা গুরুত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ পর্যবেক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
আত/২২ জানুয়ারি'২০২১