অধ্যাপক আব্দুস সালাম : ‘ওই মহামানব আসে/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে…’। জীবন সায়াহ্নে এসে শান্তিনিকেতনে বসে পঙ্ক্তিগুলো লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনন্যপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালির রবি ঠাকুর। দিনটি ছিল ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। জীবনের ৮০টি বসন্ত পেরিয়ে এসে কবি লিখেছিলেন এই বাণী। যার উদ্দেশেই রবি ঠাকুর এ পঙ্ক্তিমালা রচনা করে থাকেন না কেন, ২৫ বৈশাখ এলে বাঙালি স্মরণ করে তাকেই।
হ্যাঁ, আজ ২৫ বৈশাখ। কাব্য, গীত, কথাসাহিত্য তো বটেই, বাঙালি সত্তা ও সংস্কৃতির মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আজ। ১৬০ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি আলো করে জন্ম নেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ। এরপর গত দেড় শতক ধরে বাঙালির যাপিত জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে জড়িয়ে পড়েছেন।
কৈশোরে ছড়ার সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে শুরু। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, নৃত্যনাট্য— যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন বলছে— আজীবন দু’হাত ভরে লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। এর বাইরে তার চিঠিপত্র, ভ্রমণ কাহিনীর সংকলনও বাংলা সাহিত্যের আকর গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত। আর এসবের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করে জয় করেছেন নোবেল পুরস্কার। বাঙালির কাছে হয়ে উঠেছেন গুরুদেব, কবিগুরু, বিশ্বকবি।
এ তো গেল সাহিত্যের কথা। সাহিত্যের বাইরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এক সুমহান উচ্চতায় আসীন। কেবল গানের বাণী রচনা নয়, সেগুলোর সুরস্রষ্টা হিসেব বাংলা গানের জগতেও তিনি রয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। চিত্রশিল্পী হিসেবেও তাঁর অঙ্কনগুলো নিয়ে আজও আলোচনা-সমালোচনায় মুখর শিল্প সমালোচকরা। তিনি নিজে একজন উচ্চমানের শিল্প সমালোচক তো বটেই। এছাড়াও দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাপৃত বাঙালির জীবন-মনন-মানসে।
মা সারদাসুন্দরী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত জমিদার ও ব্রাহ্ম ধর্মগুরু। ১৫ সন্তানের জনক দেবেন্দ্রনাথ অতটা শিশু বৎসল ছিলেন না। তার ওপর বিশাল জমিদারি দেখভালের কাজে বাইরেই বড় সময় কাটত তার। ফলে তাকেও খুব একটা কাছে পাননি বরীন্দ্রনাথ। ১৪তম সন্তান হিসেবে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম, ততদিনে দেবেন্দ্রনাথের গৃহের মায়া অনেকটা শিথিল হয়েছে। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছে ভৃত্যদের অনুশাসনে।
কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নরম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। তবে তার পড়ালেখার হয়েছে মূলত ঘরেই। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন ঠাকুর বাড়ির কনিষ্ঠপুত্র (রবীন্দ্রনাথের পর বুধেন্দ্রনাথের জন্ম। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথকেই কনিষ্ঠ পুত্র বলা হয়) রবীন্দ্রনাথ। এই মুক্ত বিহঙ্গজীবনই একদিন তাকে ঘরে থেকে বের করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে ইংল্যান্ড যান ঠাকুর বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু গৃহের টান তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। বাংলার নদী, জল, ফুল, পাখি, ফল হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তাই মাত্র দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি না নিয়েই দেশে ফিরে আসেন।
১৮৮৩ সালের পারিবারিক রেওয়াজ মেনে ভবতারিণীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সদ্য কৌশোর পেরেনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী।
সন্ন্যাস জীবনের স্বপ্ন কখনও দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। বরং সন্ন্যাস জীবনের ঘোরবিরোধী ছিলেন তিনি। পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’। সে কারণেই হয়তো সংসার সাধনার মধ্যেই চলতে থাকে তার সাহিত্যচর্চা। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া, পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যার জমিদারি তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্রায় ১০ বছরের মতো সময় পূর্ববাংলায় ছিলেন। এই সময়ে তিনি জমিদারি কাজে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ি ও নওগাঁর পতিসরে অবস্থান করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে পূর্ববাংলা ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মচর্যাশ্রম।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সবকিছুর মধ্যেও ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি।
কবিগুরুর জন্মদিনে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, রবীন্দ্রনাথের বিশালতা এবং তার সৃষ্টির অপূর্ব মাধুর্যকে অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্রচর্চার বিকল্প নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন, জগৎ-সংসারকে গভীরভাবে জানতে তরুণ প্রজন্ম রবীন্দ্রসাহিত্যে অবগাহন করবে, রবীন্দ্রচর্চায় থাকবে ব্যাপৃত, যা কেবল আচারসর্বস্ব নয়, জীবনসর্বস্ব।
বিশ্বকবির জীবনাদর্শ এবং তার সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে বলে বাণী উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ বাঙালির অনন্ত প্রেরণার উৎস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার কবিতা ও গান মুক্তিকামী বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সংকট, আনন্দ-বেদনা ও আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে আন্দোলিত করে।
প্রতিবছরই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের নানা ধরনের আয়োজনে মহাসমারোহে রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উদযাপন করা হয়ে থাকে। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে কোনো অনুষ্ঠান থাকছে না। টেলিভিশন, রেডিও, দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজপোর্টালগুলো তার জীবন ও কর্মের ওপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে, লেখা প্রকাশ করছে।
অনুষ্ঠান-আয়োজন হোক না না হোক, ২৫ বৈশাখ মানেই রবীন্দ্রনাথ, ২৫ বৈশাখ মানেই বাঙালির আপনার জনকে আরও একবার ফিরে দেখা তারই আলোয়। শুভ জন্মদিন রবি ঠাকুর।
প্রধান নির্বাহী - আরেফিন শাকিল, অফিসঃ নদী বাংলা টাওয়ার, শহীদ বুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ফোনঃ 01303-166473