সাগর হোসেন : কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে গত অক্টোবরে হঠাৎ একদিন হেলিকপ্টার নামে। সুবেশী লোকজন বেরিয়ে আসেন উড়োযানটি থেকে। গ্রামের মানুষেরা সেদিন ভিড় করে হেলিকপ্টার আর সেই ব্যক্তিদের চাকচিক্য দেখেছেন। এরপর তাঁরা জেনেছেন ইউপি চেয়ারম্যানের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে রুবেল আহমেদ নামে মস্ত বড় এনজিওর এক কর্মকর্তা এসেছেন। গ্রামে তিনি ব্যাপক উন্নয়নকাজ করতে চান।
কয়েক দিন পরেই চাদট ইয়াকুব আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কনসার্ট। ঢাকা থেকে উড়ে যাওয়া জনপ্রিয় শিল্পী, জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ খোকসার নামকরা প্রায় সবাই সামনের সারিতে বসে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
ওই অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়ে জানানো হলো রুবেল আহমেদ কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশনের প্রধান নির্বাহী। তাঁর পকেটে আছে ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার অনুদান। তাই দিয়ে খোকসার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে শহুরে রোশনাই ছড়ানোর প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছেন তিনি। গ্রামে দুস্থদের জন্য পাকা ঘর হবে, গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়বে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, আধুনিক পার্ক আর নদীভাঙন রক্ষায় বাঁধ হবে, বসবে সাবমার্সিবল পাম্প (ডিপ টিউবওয়েল)। জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় আরও হাজার কোটি টাকা আসবে। এরপর আরও তিনবার হেলিকপ্টারে গ্রামে আসেন তিনি। তত দিনে এটা–সেটা বলে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রুবেল। তিন মাসের মাথায় গ্রামের লোকজন জানলেন, সব কার্যক্রম বন্ধ। টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছেন রুবেল। তাঁর সব জারিজুরি ফাঁস হওয়ার পর জানা গেল তাঁর প্রতারণার শিকার হয়েছেন কয়েক শ মানুষ, তাঁর মধ্যে দুই শ পরিবার একেবারেই পথে বসেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের ইকোনমিক ক্রাইম অ্যান্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং টিমের উপকমিশনার মাহফুজুল ইসলাম এনবি নিউজকে বলেন, রুবেলের পেশাই প্রতারণা। তাঁর বাড়ি শরীয়তপুর।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস বলে জানিয়েছেন। শুধু কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন থেকে দেড় কোটি টাকা মেরেছেন। এর আগেও কথিত প্রকল্প চালু করেছিলেন, টাঙ্গাইল, মাগুরার শ্রীপুর ও খাগড়াছড়িতে। রুবেল গ্রেপ্তারের পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
শুধু যে গ্রামের দুস্থ মানুষদের সঙ্গেই প্রতারণা করেছেন রুবেল তা নয়। তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে সাত–আটজন প্রতিষ্ঠিত ও উঠতি মডেলের যোগাযোগের তথ্য পেয়েছেন। এক শ মিউজিক ভিডিও ও সিনেমা বানানোর নামে তাঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন মো. রুবেল আহমেদ। এঁদেরই কাউকে কাউকে হেলিকপ্টারে করে খোকসায় নিয়েও গেছেন।
যেভাবে প্রতারণা
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রাথমিকভাবে খোকসায় রুবেলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল আক্তার। পরে অবশ্য বাবুলের করা মামলাতেই গ্রেপ্তার হন রুবেল। বাবুলের সুবাদেই খোকসায় এলে রুবেল থাকতেন ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। তাঁর নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক থাকত গ্রাম পুলিশ।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রুবেল আহমেদ বলেছেন, এক ব্যক্তির মাধ্যমে কয়েক মাস আগে চেয়ারম্যান বাবুল আক্তারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তিনি নিজেকে কানাডার এনজিও সিসিআরসির প্রধান নির্বাহী বলে পরিচয় দিতেন। এলাকার লোকজনকে তিনি বলেন, সিসিআরসি দরিদ্রদের ঘর তৈরি, টিউবওয়েল বিতরণ ও নদীভাঙন রোধে অনুদান দেবে। পর্যায়ক্রমে তিনি বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন এলাকা জরিপ করে দুই শ লোকের তালিকা তৈরি করেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে বলেন, এলাকায় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হবে। অফিস নির্মাণের জন্য জায়গাও ঠিক করেন। এসব প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য ৮ শতাংশ জমি রুবেল আহমেদ ৫০ হাজার টাকায় বায়না করেন। সবার বিশ্বাস অর্জনে তিনি হেলিকপ্টারে করে খোকসায় যান, ডকুমেন্টারি তৈরি করেন ও কনসার্ট করেন।
একদিন খোকসায় তাঁর সহযোগীদের রুবেল বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ১৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার তহবিল পাওয়া গেছে। এ তহবিল ছাড় করানোর জন্য আড়াই শতাংশ হারে কর দিতে হবে জানিয়ে কয়েকজনের কাছ থেকে ৪৩ লাখ টাকা আদায় করেন। ঘর নির্মাণের কথা বলে তিনজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি, সিসিআরসির নামে ভুয়া খুদে বার্তা পাঠানোর কাজে তাঁকে তানজীর সাহায্য করেছেন বলেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তিনি।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম এনবি নিউজকে বলেন, টাকাপয়সা নিয়ে রুবেল গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করছিলেন।
জানা গেছে, ২০০ মানুষকে ঘর তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুবেল আহমেদ বেশ কিছু ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলেন। তাঁরা এখন নিদারুণ কষ্টে পড়েছেন। তাঁদের এখন না আছে থাকার জায়গা, না আছে টাকা। রুবেল টাকা নিয়ে ভেগেছেন।
বনগ্রামের বাসিন্দা মকছেদ আলী মণ্ডল এনবি নিউজকে বলেন, ‘বিদেশে থি আইসি বইলো আপনাদের ঘর কইরি দিবো। অর্ধেক ঘর করেচে, এরপর পালা গেছে। ভাঙা ঘরে থাকতাম সিডা বিক্রি করি দিয়ে এখন থাকার ঘর নিই। বিপদে পড়ি গিছি।’ ৭০ বছর বয়সী রুস্তম আলী বিশ্বাস বলেন, ‘ঘর নাই, দুউর নাই। ওই দেহেন কনে শুয়ে থাহি। এই শীতের রাইতে কীভাবে থাকি। আমি ভিক্ষুক মানুষ। চার আনা পয়সা নাই। ঘর করি দিবি, এখন তারা নাইকো।’
কয়েকটি ভিটেয় রুবেলের সংস্থার পক্ষ থেকে কিছুটা নির্মাণকাজও হয়েছে। তবে সব নির্মাণসামগ্রী এসেছে বাকিতে। বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন এম এস ব্রিকসের মালিক আবদুল মজিদ এনবি নিউজকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব একদিন পরিষদে ডাকলেন। সেখানে সিসিআইসির সিইও রুবেল ছিল। বিদেশি সংস্থার উদ্যোগে এলাকায় দুস্থদের জন্য চার শ ঘর নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ৩২ লাখ ইট ও সিমেন্ট লাগবে। এ ছাড়াও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বাঁধ নির্মাণ, জলবায়ু প্রজেক্টসহ অনেক কাজ হবে বলে জানাল। ইতিমধ্যে ২ লাখ ইট ও ৬০০ বস্তা সিমেন্ট বাকিতে নিয়ে ঘরের কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু এখন শুনছি সে পালিয়েছে।’
বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের তিনটি কক্ষে প্রায় দুই মাস রুবেল ও তাঁর লোকজন ছিলেন। দিনে দুজন ও রাতে দুজন গ্রাম পুলিশ সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতেন। দিনে এলাকায় ঘুরতেন।
ওই ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শহিদুজ্জামান এনবি নিউজকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সঙ্গে সখ্য থাকায় কেউ কিছু যাচাই–বাছাই করেনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চেয়ারম্যান থাকতেন। উপজেলা প্রশাসনকেও জানানো হয়নি।’
মো. রুবেল আহমেদ তো ধরা পড়লেন, কিন্তু যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্য কী করবেন বাবুল আক্তার? গতকাল বৃহস্পতিবার বাবুল এনবি নিউজকে বলেন, ভাঙা পড়া ঘর তিনি নিজেই তুলে দেবেন। টাকাপয়সা অবশ্য উদ্ধার করতে পারেননি, পারবেন কি না জানেন না। যাচাই–বাছাই না করেই কেন কাজ দিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমিই তো রুবেলের জালিয়াতি ধরছি। মাগুরার শ্রীপুরে দুই বছর ধরে রুবেল জালিয়াতি করছে, কেউ ধরতে পারেনি।’
প্রায় দুই মাস ধরে প্রতারক চক্র নানান কর্মকাণ্ড করলেও বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানত না উপজেলা প্রশাসন। জানতে চাইলে খোকসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেজবাহ উদ্দিন এনবি নিউজকে বলেন, সিসিআইসির বিষয়ে প্রশাসন কিছুই জানত না। ব্যক্তিগত সম্পর্কে এগুলো হয়েছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান বা ইউপি সদস্যরাও কিছু জানায়নি। মামলার পর বিষয়টি নজরে আসে।
সাহো/২৯ জানুয়ারি'২০২১