নাহিদা সুলতানা : দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়া এবং এরপর হু হু করে আক্রান্তসংখ্যা ও মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পয়লা জুলাই থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউন জারি করা হয়। পরে এর মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। তবে কোরবানির ঈদ উদযাপন ও একে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহকারীদের সুবিধার্থে ১৫ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করা হয় লকডাউন। মন্ত্রিপরিষদের জারি করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আরও জানানো হয়েছে, ২৩ জুলাই ভোর ৬ টা থেকে ৫ অগাস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত আবারও সারাদেশে কঠোর লকডাউন বহাল থাকবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার যখন প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে, করোনায় দৈনিক মৃত্যুতে বাংলাদেশ যখন বিশ্বে শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে- তখন অনেকেই লকডাউন শিথিলতার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় একে সাংঘর্ষিকও মনে করছেন অনেকে। এ মুহূর্তে বিধি-নিষেধ শিথিল করার যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে আলোচনা করার আগে সাম্প্রতিক দু একটি খবরে চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
‘লকডাউনে এক অসহায় বাবার কান্না’ শিরোনামে কালের কণ্ঠে গত ৭ জুলাই প্রকাশ হওয়া একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, যশোরের শার্শা উপজেলার নিজামপুর গ্রামের এক দরিদ্র সিএনজি চালক শাহ আলম যার ঘরে ২২ দিন বয়সী শিশুসন্তান এবং কঠোর লকডাউনে যার আয় সম্পূর্ণ বন্ধ- ক্ষুধার্ত সন্তানের কান্না সহ্য করতে না পেরে চক্ষুলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে নিজে কাঁদতে কাঁদতে লোকালয়ে নেমে পড়েছিলেন সামান্য সহযোগিতা পাবার আশায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শাহ আলমের মত শত শত অসহায় বাবা ও তাদের অবুঝ সন্তানদের কান্নার দায় কি এড়াতে পারে সরকার?
আরেক নিউজ ওয়েব পোর্টালে ৭ জুলাই এক যুবকের আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশ হয়- যেখানে বলা হয় করোনা মহামারীতে চাকরি হারিয়ে ও পারিবারিক কলহের জেরে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় আত্মহত্যা করেন আজিজুল হাকিম টনিক নামে ৪০ বছরের এক ভদ্রলোক। এখানে প্রশ্ন জাগে যে কোভিড পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া হাজার হাজার ব্যক্তির সাংসারিক টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও মানসিক বিপর্যয়ে ভোগার দায় কি এড়াতে পারে সরকার?
অন্যদিকে করোনার প্রকোপ যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে পরিস্থিতি করুণ হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলমান বিধি-নিষেধ শিথিল করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন গণপরিবহন, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, শপিং মল, পশুর হাট সব খুলে দিলে আক্রান্ত ও মৃত্যুসংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে, আর এমনটা হলে আবারও প্রশ্ন ওঠে যে সেই দায় কি এড়াতে পারে সরকার?
উপরে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তরের মাঝে নিহিত রয়েছে লকডাউন শিথিলতার তাৎপর্য আর উত্তরটা হচ্ছে- না, কোন দায়ই সরকার এড়াতে পারে না। সরকারকে সার্বিক দিক বিবেচনা করেই যেকোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একদিকে যেমন জনগণের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়, অন্যদিকে তেমন জীবন ধারণের জন্য সর্বসাধারণ এর জীবিকা নির্বাহের পথও সুগম করতে হয়। লকডাউন মেনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি বাসায় বসে থাকলেও খুব বেশিদিন তাদের পক্ষে মানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কেননা খাদ্যাভাব ও আর্থিক সংকট দেখা দিলে অর্থ জোগাতে তাদের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হয়।
করোনাভাইরাসে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে খেটে খাওয়া দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী, হকার, কল-কারখানা/ দোকানপাট/ শপিং মলে নিয়োজিত কর্মীসহ আরও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেব অনুযায়ী, দেশে যাত্রীবাহী সড়ক ও নৌ শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ।
দেশে মজুরিভুক্ত শ্রমশক্তি ২ কোটি ৪২ লাখ যার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৮৩ লাখ ৩২ হাজারই দিনমজুর (তথ্যসূত্র: বিবিএস লেবাস ফোর্স সার্ভে ২০১৭) । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে ২০২০ এ দেখা গেছে, সারাদেশে বিভিন্ন দোকানে নিয়োজিত আছে ১.৩৯ লক্ষ কর্মী। উপরন্তু যোগ হয়েছে করোনার বদৌলতে বিদেশ ফেরত ও চাকরিচ্যুত হয়ে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা প্রায় দুই কোটি জনগোষ্ঠী। গত ৭ জুন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনায় কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ফলে যে প্রভাব পড়েছে সে চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে যা বিবিএস এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে অনুমিত হিসেবে যা নেমে এসেছিল সাড়ে ২০ শতাংশে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। দিন এনে দিন খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলো করোনায় গৃহবন্দি হয়ে তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে পারছে না।
এতক্ষণ তো সরকারকে প্রশ্ন করা হলো, এবার যদি সরকার পাল্টা প্রশ্ন করে যে এ বিশাল সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অভুক্ত রেখে, মানবেতর জীবন যাপনের দিকে ঠেলে দিয়ে বাকিরা মিলে শান্তিতে ঈদ উদযাপন করতে পারবে কিনা এবং খাদ্যাভাবে দরিদ্ররা মৃত্যুবরণ করলে তার দায় জনগণ এড়াতে পারবে কিনা, তবে কী জবাব দিব আমরা তা কি একবারও ভেবে দেখেছি?
লকডাউন শিথিলের প্রথম যৌক্তিকতা হচ্ছে দরিদ্রশ্রেণির মানুষকে না খেয়ে মারা যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো। এই দুঃসময়ে একটি আশাব্যঞ্জক সংবাদ হচ্ছে কোরবানির ঈদ পালনের নিমিত্তে সরকার ইতিমধ্যে দরিদ্রদের জন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এটা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সবাইকে এ প্রণোদনার আওতায় আনা এবং সরকারের একার পক্ষে এত সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা প্রায় অসম্ভব। তাই লকডাউনে যাদের আয় বন্ধ থাকে, তারা ৭টা দিন আয় রোজগার করে পরবর্তী ১৪ দিন যেন অন্তত বেঁচে থাকতে পারেন সেজন্য বিধি-নিষেধ শিথিলতার দিকে যাওয়া।
লকডাউন শিথিলের দ্বিতীয় যৌক্তিকতা হচ্ছে দেশের অর্থনীতির চাকাকে অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও সচল করা। তৃতীয় যৌক্তিকতা হচ্ছে শেকড়ের টানে গ্রামে ছুটে যাওয়া মানুষজনকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানো। এ ব্যাপারে ১৩ জুলাই একটি ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, “একটি রাষ্ট্রের ওপর অনেক দায়িত্ব থাকে। সরকার বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে এই শিথিলতার পথে যাচ্ছে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো অনেক বেশি সংবেদনশীল। সৌদি আরব ঈদুল আজহার সময়েও কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশে সেই সামাজিক অবস্থা তৈরি হয়নি, যেখানে আমরা বৃহৎ স্বার্থে মানুষকে ঈদের আমেজ থেকে দূরে রাখতে পারব।”
একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, গত রোজার ঈদে ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছিল কিন্তু তাতে বাড়ি যাওয়া মানুষের ঢল ঠেকানো তো যায়নি মোটেই, উল্টো পরিবহন স্বল্পতায় গাদাগাদি করে, ভিড় ঠেলে তারা নিজেরা সংক্রমিত হয়েছেন, অন্যকে সংক্রমিত করেছেন এবং সেই সাথে বাড়িতে করোনা বয়ে নিয়ে গেছেন। তাই গণপরিবহন বন্ধ রাখার চেয়ে খুলে দেয়াই বরঞ্চ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যাতে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
এজন্য সরকারকে ভারসাম্য বজায় রেখে, আগে পরে উভয় দিকেই ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন দিয়ে মাঝে মাত্র এক সপ্তাহের জন্য শিথিল করতে হয়েছে যাতে জীবন ও জীবিকা কোনটার উপরই বিরূপ প্রভাব না পড়ে। আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, সরকার নানামুখী পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার। কিন্তু আমাদের নিজেদের অসচেতনতার দরুণ যদি সংক্রমণ বেড়ে যায় সেই দায় আমরা কোনভাবেই সরকারের ওপর চাপাতে পারি না।
কঠোর লকডাউনের ১৩ তম দিনেও জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়ায় রাজধানীজুড়ে ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপি। বাসায় চা না বানিয়ে টং দোকানের চা খাওয়া কিংবা লকডাউন কেমন চলছে নিছক সেটা দেখার অজুহাতে বিধি-নিষেধ অমান্য করে যারা বাসা থেকে বের হয় তাদের মাঝে আত্মোপলব্ধি, আত্মসচেতনতা তৈরী না হওয়া পর্যন্ত কঠোর, সীমিত, সর্বাত্মক লকডাউন কিংবা শাটডাউন, কোনকিছুতেই করোনার সংক্রমণ বিস্তার আটকানো যাবে না। নিজের বুঝ নিজে না বুঝলে পৃথিবীর কেউই আপনাকে, আমাকে বোঝাতে পারবে না। কথায় আছে, নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। আর আমরা তো সবাই সুস্থ মস্তিষ্কেরই মানুষ। আমরা যদি প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে একটু সচেতন হই তাহলে কিন্তু আর কঠোর কিংবা শিথিল, কোনও লকডাউনই দেবার প্রয়োজনীয়তা থাকেনা। উপরন্তু খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে কর্মসংস্থান হারিয়ে পথে বসতে হয় না।
করোনাভাইরাসকে ভয় পেলে চলবে না, আবার শুধু লকডাউন দিয়ে একে পরাস্ত করা যাবে না। আর দীর্ঘদিন লকডাউন দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই কোভিডের প্রকোপ কমাতে লকডাউন নয়, জনসচেতনতাই আসল। আর স্থায়ীভাবে সমাধান পেতে হলে পরীক্ষা বাড়ানো, চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন ও যত দ্রুত সম্ভব সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনার বিকল্প নেই।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তার উটপাখি কবিতায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, “অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?”। যে লোকটি কেবল এটা দেখার জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছে- লকডাউন কেমন চলছে, সে তো অন্ধ বটেই, যে ঘরে চুপটি মেরে বসে থেকে ভাবছে তার মত সুরক্ষিত ব্যক্তি আর কেউ নেই সেও অন্ধের মতই আচরণ করছে। কেননা ঘরে বেশিদিন বসে থাকা যায় না, জীবিকার তাগিদে ঘর হতে বাইরে পা বাড়াতে হবেই আর বের হওয়া মানেই ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া। একমাত্র সচেতনতাই পারে আমাদের এই মহামারীর ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করতে। আমাদেরকে ধীরে ধীরে নিও নরমালে অভ্যস্ত হতে হবে। সুতরাং, জনগণ আসুন আমরা একটু সচেতন হই। মাস্ক পরিধান করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হই, করোনা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং অন্যকেও মানতে উদ্বুদ্ধ করি।
প্রধান নির্বাহী - আরেফিন শাকিল, অফিসঃ নদী বাংলা টাওয়ার, শহীদ বুলু স্টেডিয়াম সংলগ্ন, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী। ফোনঃ 01303-166473