এদিকে বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের দাবির বিষয়ে বাংলাদেশের যুক্তির বিপক্ষে আপত্তি জানিয়ে ভারত গত এপ্রিলে জাতিসংঘকে একটি চিঠি দিয়েছিল। ভারতের সেই চিঠির বিষয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিবকে পৃথক আরেকটি একটি চিঠি দেয় বাংলাদেশ। ওই চিঠিতে বাংলাদেশ বলেছে, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা অনুসরণ করেই মহীসোপানের দাবি নির্ধারণ করেছে ঢাকা।
সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর ভূখণ্ডের যে অংশ সমুদ্রের দিকে পানির নিচে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে যায়, তাকে মহীসোপান বলে। সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেসলাইন বা ভিত্তিরেখা থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের সাড়ে তিন শ মাইল এলাকাকে সংশ্লিষ্ট দেশের মহীসোপান বলা হয়। এর মধ্যে ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। সেখানে অন্য কোনো দেশ মাছ ধরতে পারে না এবং খনিজ সম্পদের দাবি করতে পারে না। এই ২০০ মাইলের পর ১৫০ মাইল পর্যন্ত সীমায় সমুদ্রের তলদেশে খনিজ সম্পদের মালিক ওই দেশ, তবে মাছ ধরতে পারে সব দেশ।
সাত বছরের নিষ্ফল প্রয়াস
নিজের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য ভারত ২০০৯ সালের মে মাসে উপকূলীয় একটি ভিত্তিরেখা বা বেসলাইন ব্যবহার করে আসছে। ওই ভিত্তিরেখার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ ২০০৯ সালের অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। তাতে ভারতের ওই ভিত্তিরেখার একটি অংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকায় তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ভুলটি সংশোধনের অনুরোধ করা হয়। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত দুই নিকট প্রতিবেশীর সীমানা নির্ধারণ করে রায় দেওয়ার পর ভিত্তিরেখার বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সুরাহার অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দেয়নি ভারত।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল সন্ধ্যায় এনবি নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত ২০১৪ সালে যে রায় দিয়েছেন, তা দুই পক্ষ মেনে নিয়েছে। ওই রায়ের পর এখন নতুন করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশ উল্লেখ করেছে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ বিষয়টি জাতিসংঘ এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে জানায়নি। কিন্তু এখন বাংলাদেশ পরিষ্কারভাবে ভারতের এ অবস্থানের বিরোধিতা করছে। ভারত বিষয়টি সুরাহা না করে জাতিসংঘকে অবহিত না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ এ বিরোধিতা করতে থাকবে। ভারতের ভিত্তিরেখার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ১৯৭৬ সালে ভারত টেরিটোরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোন–সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করে। এর ৩৩ বছর পর ২০০৯ সালে ভিত্তিরেখা নির্ধারণের জন্য সংশোধনী আনে। আগের নিয়মে সমুদ্রের পানির নিম্নস্তর থেকে ভিত্তিরেখা নির্ধারণের বিধান থাকলেও বর্তমানে তারা ‘স্ট্রেট লাইন বেসলাইন’ পদ্ধতি ব্যবহার করছে, যা আনক্লজের (জাতিসংঘের সমুদ্র আইনবিষয়ক কনভেনশন) ৭ নম্বর ধারার পরিপন্থী।
ভিত্তিরেখা সমুদ্রতীর থেকে নির্ধারণের বিধান থাকলেও ভারতের কিছু ভিত্তিরেখা সমুদ্র থেকে ধরা হয়েছে। যেমন ৮৭ নম্বর ভিত্তি পয়েন্টটি সমুদ্র থেকে শুরু। সেখান থেকে ভারতীয় উপকূল আনুমানিক সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল (নৌমাইল) দূরে। ভারতের ৮৯ নম্বর ভিত্তি পয়েন্টের অবস্থান বাংলাদেশের জলসীমানার প্রায় ২ দশমিক ৩ মাইল অভ্যন্তরে, যা নিয়ে বাংলাদেশ বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন বলে জাতিসংঘকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম এনবি নিউজকে বলেন, ‘ভারত যেভাবে তাদের বেসলাইন নির্ধারণ করেছে, সেটি আনক্লজের ৭ নম্বর ধারার পরিপন্থী। তাই আমরা এ নিয়ে আমাদের আপত্তি তুলে ধরেছি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হয়। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা
মহীসোপানের দাবির পক্ষে চিঠি
এর আগে গত এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান নিয়ে বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে ভারত আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘকে। ওই চিঠিতে বাংলাদেশের দাবি বিবেচনা না করার জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করা হয়েছিল।
এপ্রিলে ভারতের দেওয়া ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের রায় অনুসরণ করে মহীসোপানের দাবি নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই রায় পাওয়ার পরে দুই দেশ সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে। পাশাপাশি সীমানা বিন্দু কী হবে, সেটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়। এরপর আর কোনো বিরোধ থাকতে পারে না বলে বাংলাদেশের চিঠিতে মন্তব্য করা হয়।
এ বিষয়ে অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত বিরোধ জাতিসংঘের সালিসি আদালত নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। এরপর অন্য কোনো দাবি জাতিসংঘের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার যৌক্তিকতা নেই।