এনবি নিউজ : প্রতিবছর অক্টোবর থেকে কমতে থাকে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৌসুম শেষে কমে আসে আক্রান্তের হার। কিন্তু এবার নভেম্বরেও ঊর্ধ্বমুখী ডেঙ্গু। এখন বছরজুড়েই থাকছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এর সঙ্গে কিউলেক্স মশার কামড়ে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘প্রতিবছর অক্টোবরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে আসে। কিন্তু এ বছর মৌসুম শেষ হলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ঊর্ধ্বমুখী। অসময়ের এই বৃষ্টির কারণে এডিস মশার লার্ভা জন্মানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আসলে ডেঙ্গু এখন সারা বছরই থাকবে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে কিউলেক্স মশা।’ তিনি বলেন, ‘মশক নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থাপনা এবং কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যবস্থাপনা নিতে হবে। মশক ব্যবস্থাপনায় চারটি দিক রয়েছে। সেগুলো হলো পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, কীটনাশক, বায়োলজিক্যাল ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটিকে সংযুক্ত করা। এ চারটি বিষয় খেয়াল রেখে কাজ করলে মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১১০ জন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৭৫ জন এবং রাজধানীর বাইরে ৩৫ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজার ৪৫৩ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন ২৫ হাজার ৮২৪ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৯৮ জন। দেশের হাসপাতালে বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ৫৩১ জন।
এ বছরের জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে তিনজন, মে মাসে ৪৩ জন, জুন মাসে ২৭২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। জুলাই মাসে এ সংক্রমণ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। আগস্ট মাসে এ সংখ্যা ছিল তিন গুণেরও বেশি- ৭ হাজার ৬৯৮ জন। সেপ্টেম্বর মাসে মোট ৭ হাজার ৮৪১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪৫৮ জন। নভেম্বরে গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৭৯৮ জন। এ বছর জুলাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১২ জন, আগস্টে ৩৪ জন, সেপ্টেম্বরে ২৩ জন, অক্টোবরে ২২ জন, নভেম্বরে সাতজন। মৌসুম শেষ হয়ে গেলেও কমেনি ডেঙ্গু আক্রান্তের হার। আবহাওয়ার পারদ নিচে নামতেই সজাগ হচ্ছে কিউলেক্স মশা। সূর্য ডুবলেই দরজা-জানালা গলে বাসা-অফিসে হানা দিচ্ছে মশা। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। ডেঙ্গু মৌসুমে দুই সিটি করপোরেশন বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু এখন মশক নিধনে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। দুই সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাসার আশপাশে ছাড়া কোথাও ফগিং চোখে পড়ে না।
রাজধানীর মহানগর প্রজেক্টের বাসিন্দা চারুলতা বিশ্বাস বলেন, ‘বিকাল হতেই বাসার সব জানালা বন্ধ করে দিই। কিন্তু তাতেও নিস্তার মেলে না। মশার কামড়ে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসতে পারে না। কয়েল, ব্যাট কিছুইতেই যায় না মশা।’ তিনি বলেন, ‘দিনে এডিস মশার ভয়, রাতে কিউলেক্স মশার কামড়। আগে তাও সিটি করপোরেশন থেকে ফগিং করা হতো। গত দুই মাসে আমাদের এখানে কোনো মশক নিধন কার্যক্রম চোখে পড়েনি।’ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ করলেও বহাল তবিয়তে আছে মশা। ওষুধ কিংবা ধোঁয়া কোনো কিছুই বাগে আনতে পারছে না মশাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মশক নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বরাদ্দ রেখেছে ১১০ কোটি টাকা।
এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ৪৫ কোটি টাকা, আগাছা ও কচুরিপানা পরিষ্কার করতে ৩ দশমিক ৫০ কোটি, মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ৩ কোটি টাকা, আউট সোর্সিংয়ে ২৭ কোটি টাকা, চিরুনি অভিযান পরিচালনায় ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। এ ছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ডিএনসিসি বরাদ্দ রেখেছে ২৫ কোটি টাকা।
এ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ দশমিক ৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ২২ দশমিক ৫০ কোটি টাকা, আগাছা ও কচুরিপানা পরিষ্কার করতে ৫ লাখ টাকা, মশক নিধনের যন্ত্রপাতি পরিবহনের জন্য ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ডিএসসিসি বরাদ্দ রেখেছে ৯ কোটি টাকা। প্রতিবছর মশক নিধন খাতে এ রকম বরাদ্দ থাকলেও উপদ্রব কমছে না মশার। বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরের ভয় আর বাকি সময় ঝাঁকে ঝাঁকে কিউলেক্স মশার কামড়ে ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে প্রাণ। গুলশান সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ মো. আবদুল্লাহ আল জহির স্বপন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যে মশার ওষুধ দেয় তাতে কাজ হয় না। ফগিং করলে মশা অধিকাংশ উড়ে যায়। এ ওষুধে মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়’।