আফগানিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট অব আফগানিস্তান (এনআরএফ) দাবি করেছে, তাদের হাজারো সেনা তালেবানের বিরুদ্ধ লড়াইয়ে প্রস্তুত। তবে সংগঠনটি এও বলছে, তারা তালেবানের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যেতে চায়।
এনআরএফের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক প্রধান আলী নাজরি বিবিসিকে বলেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু আলোচনা বিফল হলে কোনো রকমের সহিংসতা সহ্য করবে না বলে হুঁশিয়ার করেন আলী নাজরি।
এদিকে তালেবানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা এনআরএফের পানশির উপত্যকার দুর্গ ঘিরে ফেলেছে এবং সেখানে থাকা এনআরএফ যোদ্ধাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
এনআরএফের এক মুখপাত্র বলেন, তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী কাবুলের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পানশিরে যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সেনারা তৈরি। কিন্তু আমাদের আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম প্রয়োজন।
২০ বছর ধরে তালেবানের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসা জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই প্রথমবার ক্যামেরার সামনে আসেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আফগানিস্তানে আর সংঘাত চায় না তালেবান। দেশের ভেতর ও বাইরে আর কাউকে শত্রু হিসেবে চায় না। তারা সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে তালেবান। তালেবান ঘোষণা দিয়েছে, সামনের সপ্তাহেই তারা সরকার গঠনের রূপরেখা প্রকাশ করবে। সেখানে কারা থাকবে বা সরকারপ্রধান কে হবেন, এ বিষয়ে স্পষ্ট করা হয়নি।
আফগানিস্তানের আশরাফ গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বর্তমানে পানশিরে অবস্থান করছেন। এক টুইটবার্তায় তিনি বলেন, তালেবান যোদ্ধারা পানশিরের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছে।
কাবুল থেকে পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হিন্দুকুশ এলাকায় অবস্থিত পানশির। আফগানিস্তানে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত আগ্রাসন প্রতিরোধ করেছে এ উপত্যকার যোদ্ধারা। আবার ১৯৯০-এর দশকে তালেবানের পাঁচ বছরের শাসনের সময় এলাকাটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এবারও পানশির নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়েছে তালেবান। বর্তমানে এলাকাটি এনআরএফের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এনআরএফের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ মাসুদ। মূলত ৩২ বছর বয়সী আহমেদ মাসুদের আশ্রয়েই রয়েছেন আমরুল্লাহ সালেহ। এই আহমেদ মাসুদ আবার পানশিরের কিংবদন্তি নেতা আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার দুদিন আগে তাঁকে হত্যা করেছিল আল–কায়েদা।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আহমেদ শাহ মাসুদ ছিলেন শক্তিশালী গেরিলা কমান্ডার, যিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৯০-এর দশকে মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে আফগান সরকারের সামরিক শাখার নেতৃত্ব দেন। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময় ২০০১ সালে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী কমান্ডার ছিলেন।
আলী নাজরি বলেন, আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা তালেবানবিরোধী সংগঠনগুলোর যোদ্ধারা পানশিরে এসে পৌঁছেছে। ইতিমধ্যে তারা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। হাজার হাজার যোদ্ধা এ মুহূর্তে প্রতিরোধ গড়তে প্রস্তুত। তবে বিবিসির পক্ষ থেকে তাঁর এই দাবির সত্যতা যাচাই করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নাজরি এও বলেন, ‘যেকোনো যুদ্ধ বা সংঘাতে জড়ানোর আগে আমরা শান্তি আলোচনার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা শান্তি পছন্দ করি, শান্তি ও আলোচনাই আমাদের অগ্রাধিকার। যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় বা অন্য পক্ষ আন্তরিক না হয় এবং যদি দেখি, তারা দেশের বাকি অংশে জোর করে ক্ষমতা দখল করছে, তাহলে কোনো রকমের সহিংসতা সহ্য করা হবে না। এর আগেও আমরা নিজেদের প্রমাণ করেছি। গত ৪০ বছর কেউ আমাদের অঞ্চল, বিশেষ করে পানশির উপত্যকা জয় করতে পারেনি।’
১৯৯০-এর দশকে তালেবানের পাঁচ বছরের শাসনের সময় এলাকাটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এবারও পানশির নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে ব্যর্থ হয়েছে তালেবান। বর্তমানে এলাকাটি এনআরএফের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তবে এবার তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে তারা ঠিক কতটা পেরে উঠবে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। কারণ, পানশিরের তাজিকিস্তান সীমান্ত দিয়ে সামরিক উপকরণ সংগ্রহ করে এনআরএফ। সেই পথ এখন তালেবান নিয়ন্ত্রণে। আর ‘পানশিরে তালেবানবিরোধী হাজারো যোদ্ধা জড়ো হয়েছে’—নাজরিরের এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করাও সম্ভব হয়নি। তিনিও এর পক্ষে কোনো তথ্য–প্রমাণ দেননি। তাই সেখানে থাকা যোদ্ধাদের সংখ্যাটা অস্পষ্টই বলা চলে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সাবেক আফগান কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, সেখানে সাবেক আফগান সেনাসদস্য আর মার্কিন প্রশিক্ষিত যোদ্ধার সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাজরি সেখানে সব মিলিয়ে তালেবানবিরোধী নয় হাজার যোদ্ধা থাকার তথ্য দেন।
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত আহমেদ মাসুদের লেখা এক নিবন্ধে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার আহ্বান করেছেন। তিনি বলেন, ‘পানশিরে যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সেনারা তৈরি। কিন্তু আমাদের আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম প্রয়োজন।’
অন্যদিকে, তালেবানের কাছে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া হাজার কোটি ডলারের ব্লাক হক হেলিকপ্টার, ড্রোন, হাম্বি আর মাইনপ্রতিরোধী গাড়ির মতো সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে, যেগুলো তারা আফগান সেনাদের দিয়ে গেছে। এসবের সামনে তালেবানবিরোধী যোদ্ধারা ঠিক কতক্ষণ টিকে থাকে, সেটাও দেখার বিষয়।