এনবি নিউজ : বিয়ে বা চাকরি প্রলোভন অথবা উন্নত জীবনের আশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে, ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নারীদের পাচারে টার্গেট করছে দালাল চক্র। নারীদের বিনা খরচে নিলেও পুরুষদের কাছে আদায় করা হচ্ছে টাকা।
সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে সোমবার রাতে মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে উদ্ধার করে কক্সবাজারে আনা ১৪৯ রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই এমন তথ্য দিয়েছেন। আর এসব পেছনে কারা জড়িত তা তথ্য সংগ্রহ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে ট্রলার থেকে ‘দালাল চক্রের’ নামিয়ে দেওয়া ১৪৯ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। সোমবার বিকালে মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ঘুরাঘুরি করা এসব রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া ১৪৯ জনের মধ্যে ৭৫ জন নারী, ৫১ জন পুরুষ ও ২৩ জন শিশু। এসব রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা।
তিনি জানান, উদ্ধার হওয়ারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে, তারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক সক্রিয় একটি দালাল চক্র সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রলারে তোলে। পরে সোমবার এসব রোহিঙ্গাদের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপে নামিয়ে দেয়। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের ৫টি ট্রলারে করে সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে মঙ্গলবার মধ্যরাতে কক্সবাজারস্থ বাঁকখালী নদীর ৬নং ঘাটে আনা হয়।
সরেজমিনে বাঁকখালী নদীর ৬নং ঘাটে দেখা যায়, কারও বয়স ১২, কারও বয়স ১৬ আবার কারও কারও বয়স ১৮ এর বেশি। আর যাদের বয়স ২৫ এর বেশি তাদের কোলে রয়েছে শিশু। এসব রোহিঙ্গা তরুণীদের সবার গন্তব্য ছিল সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া গমন। বিয়ের প্রলোভন, স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বা চাকরির স্বপ্ন- দালাল চক্রের পাতা এমন প্রলোভনের ফাঁদে পা বাড়িয়ে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে নামে এই রোহিঙ্গারা।
উদ্ধার হওয়া ১৬ বছরের রোহিঙ্গা তরুণী ফাতেমা বলেন, বিয়ে করতে মালয়েশিয়া যাচ্ছি, মোবাইলের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় স্বামী ঠিক করা আছে। স্বামী নিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় গেলেই আমাদের বিয়ে হবে।
উদ্ধার হওয়ার ১৫ বছরের আরেক তরুণী আছিয়া বলেন, ক্যাম্পে বিয়ে দিতে কষ্ট হচ্ছে, মা-বাবা বলেছে চোখ যেদিকে যাও সেদিকে চলে যাও। আল্লাহ উপর ভরসা করে মালয়েশিয়া ট্রলারযোগে রওনা হয়েছিলাম। পরে সোনাদিয়া থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে।
নাম জানাতে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন তরুণী বলেন, মালয়েশিয়ায় আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা দালাল চক্রের মাধ্যমে ট্রলারযোগে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বেশি টাকায় চাকরি করতে পারবো।
উদ্ধার হওয়া আরেক রোহিঙ্গারা নারী খতিজা বলেন, মালয়েশিয়ায় আত্মীয়-স্বজন আছে, তারা নিয়ে যাচ্ছে তাই চলে যাচ্ছি। এখন যেহেতু দেশে যেতে পারছি না। আর ক্যাম্পেও থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছি।
দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের নারীদের বিনা খরচে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ট্রলারে তুললেও পুরুষ কাছ থেকে আদায় করা হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা। আর তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখালেও ট্রলারে তুলে করা হয় অমানবিক নির্যাতন।
উদ্ধার হওয়া আব্দুল্লাহ বলেন, টেকনাফ থেকে ছোট ট্রলারে করে সাগরে যাই। ওখানে ১০ থেকে ১২ দিন মতো সাগরে ছিলাম। দালালরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে শেষ পর্যন্ত কিছু করতে না পেরে ট্রলার সোনাদিয়ায় এনে নামিয়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দালাল ৪০ হাজার টাকা নিয়েছে। ট্রলারে ১৯২ জন ছিলাম।
উদ্ধার হওয়া আরেক রোহিঙ্গা ইসলাম বলেন, ভাই মালয়েশিয়া থাকে। সে ফোনে ক্যাম্পের জামতলী বাজারে সিএনজি নিয়ে একটা মানুষ আসবে, তুমি সেখানে দাঁড়াবে এবং তার সঙ্গে টেকনাফ যাবে। দর-দাম করে দালালকে টাকা দিয়ে তোমাকে মালয়েশিয়া আনার চেষ্টা করছি। এরপর ওই মানুষ মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য টেকনাফ উপকূল দিয়ে ট্রলারে তুলে দেয়।
মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ কামাল বলেন, সক্রিয় দালালচক্র অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রলোভন দেখিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর নামে নানা প্রতারণা করছে। উদ্ধার হওয়ার রোহিঙ্গাদের দুপুরে এবং রাতে খাবারসহ সব ধরনের সহযোগিতা করেছি। আর এসব দালালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
কক্সবাজার মহেশখালী (সার্কেল) এর সহকারী পুলিশ সুপার আবু তাহের ফারুকী বলেন, সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের পেছনে কারা জড়িত তা তথ্য সংগ্রহ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর উদ্ধার হওয়ার রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ টি