এনবি নিউজ : রেলওয়েতে অস্থায়ীভাবে কর্মরত প্রায় ৯ হাজার কর্মচারির ভবিষ্যত অনিশ্চয়তায় পড়েছে। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি ডিসেম্বরেই অস্থায়ী এসব কর্মচারীর চাকরি শেষ হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত এসব কর্মচারীকে বাদ দিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে জনবল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মচারীর মধ্যে চাকরি হারানোর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এসব কর্মচারীর পরিবারের রুটি রুজি নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক এসব কর্মী ছাঁটাই হলে রেলওয়ের বিভিন্ন সেবায় তীব্র সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, জনবল সঙ্কট মেটাতে বিভিন্ন সময়ে রেলওয়েতে পয়েন্টসম্যান, খালাসি, গেটকিপার, ওয়েম্যান, পোর্টার, সিগন্যাল খালাসি পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে এসব কর্মী নিয়োগ করা হয়। পদগুলো সবই চতুর্থ শ্রেণিভুক্ত। রেলওয়ের দুই অঞ্চল মিলে এসব কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার।
দিনে দিনে প্রশিক্ষিত হয়ে তারা এখন রেলওয়ের বিভিন্ন সেবায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেকেই গত ২০ বছর ধরে আছেন এসব পদে। এসব কর্মচারীকে দিনভিত্তিক মজুরি হিসেবে বেতন দেওয়া হয়।
জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রেলপথ মন্ত্রণালয় অস্থায়ী এসব কর্মীদেরকে ছাটাই করতে যাচ্ছেন। রেলওয়ের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ৩১ ডিসেম্বর বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী কর্মীর চাকরি শেষ হতে যাচ্ছে। এসব কর্মীকে বাদ দিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে রেলওয়ের এসব পদে কর্মী নিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। অনেক ঠিকাদার কর্মী নিয়োগের বরাত পেতে মন্ত্রণালয়ে তদবির ও দৌড়ঝাঁপ করছেন।
এদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে বছরে অন্তত ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে রেলের। এমনিতেই লোকসানে ধুঁকছে রেল। এর ওপর দক্ষ জনবল বাদ দিয়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নতুন লোকবল নিয়োগ দিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ব্যয় আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে রেলসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলেই রয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার অস্থায়ী কর্মচারী। তাদের মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৗশলীর দপ্তরের আওতায় দুই হাজার ৫০৮ জন, সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার আওতায় ৫০০ জন, পাকশী ডিভিশানের যন্ত্র প্রকৌশল দপ্তরের আওতায় ২০৩ জন, বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলের (সিএন্ডডব্লিউ) আওতায় রয়েছেন ২১৩ জন। এর বাইরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আওতায় রয়েছেন আরও প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী। আর রেলের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছেন আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মচারী।
এসব কর্মচারীর বেতন ভাতা খাতে প্রতি মাসে রেলের প্রায় ব্যয় হয় ১২ কোটি টাকা। কর্মচারীদেরকে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এ টাকা প্রদান করা হয়। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ১৪৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
অন্যদিকে ঠিকাদার আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৯ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে সেখানে রেলের ব্যয় বাড়বে অন্তত ২০ থেকে ২৫ ভাগ। ঠিকাদারের মুনাফা, ভ্যাট-ট্যাক্স ও প্রশিক্ষণ খরচসহ আনুষঙ্গিক খাতে খরচে যাবে সেই টাকা। এতে বছরে অন্তত ২৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে রেলের। আর এসব কর্মচারী নিয়োগে হবে বিপুল নিয়োগ বাণিজ্য।
রেলওয়ের অস্থায়ী কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিঠুন হোসেন বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে জনবল সরবরাহ করা হলে ঠিকাদাররা তাদের ইচ্ছামতো জনবল নিয়োগ দেবেন। করবেন নিয়োগ বাণিজ্য। নতুন করে যাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাদের দিয়ে চলমান রেলসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে রেলসেবায় চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এছাড়া রেলে বাড়বে দুর্ঘটনা এবং যাত্রীদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের চাকরি স্থায়ীকরণসহ ছাঁটাই না করতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সরকার আমাদের কথা শুনছেন না। টনক নড়বে তখন, যখন রেল একের পর এক অদক্ষ জনবলের কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়বে। আবার অতিরিক্ত টাকাও ব্যয় হবে। এসব একশ্রেণির আমলার স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়।
হাসান আলী নামের এক অস্থায়ী কর্মচারী বলেন, আমি প্রায় তিন বছর ধরে পয়েন্টসম্যান হিসেবে কাজ করছি। কাজ শিখতেই আমার প্রায় দুই বছর লেগেছে। এখন শুনছি অন্যদের মতো আমাকেও বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু নতুন লোক এসে আমার এই কাজ কীভাবে করে দেবেন। তাকে তো শিখতেই অন্তত দুই বছর কাটাতে হবে। আবার চাকরি হারিয়ে আমার মতো হাজার হাজার কর্মচারীর পরিবারে নেমে আসবে দুঃসহ যন্ত্রণা।
নাজমুল হোসেন নামের আরেক কর্মচারী বলেন, রেলেওয়ের প্রতিটি কাজই দক্ষতার সঙ্গে করতে হয়। সেখানে নতুন লোক এসে কাজ করতে পারবে না। আবার ঠিকাদার নিয়োগ বাণিজ্য করবেন। সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টে এসব করা হচ্ছে।
রেলওয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আক্তার আলী বলেন, রেল একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। এখানে অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার ভিত্তিকে কাজে লাগানো হয়। এখন যারা অস্থায়ী কর্মচারী আছেন, তাদের সবার সর্বনিম্ন তিন বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেকের ২০ বছরেরও অভিজ্ঞতা আছে রেলওয়ের কাজে। কিন্তু এসব কর্মচারীকে বাদ দিয়ে আউটসোর্সিংয়ে আসা অদক্ষ কর্মী দিলে রেল নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
তিনি আরও বলেন, অতীতে দেখা গেছে, আউটসোর্সিংয়ের কাজ পাওয়া ঠিকাদার লোকবল নিয়োগ করতে গিয়ে বাণিজ্য করেছেন। তাতে যারা এখন কর্মরত আছেন, অনেকেই টাকার অভাবে ঠিকাদারকে ঘুস দিতে পারবেন না। এতে করে বাদ পড়বেন অনেকেই। সরকারকে বিতর্কিত করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হলে রেলের ব্যয় বাড়বে অন্তত ১৫ ভাগ। এর বাইরেও নানা খরচ যুক্ত হবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের কারণে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেই পথেই হাঁটছেন। এখানে আমাদের কিছু করার নাই। অনেক মানুষ একসঙ্গে চাকরি হারালে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকবে।
এ টি