এনবি নিউজ : করোনা মহামারিতে দেশে রক্তের সংকট দেখা দিয়েছে। কয়েক দফায় লকডাউন এবং সংক্রমণের আতঙ্কে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার কতদিন পর রক্ত দিতে পারবেন, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে জীবন বাঁচাতে যাদের প্লাজমা প্রয়োজন তারা এবং থ্যালাসেমিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আক্রান্ত পরিবারের কাছে এক ব্যাগ রক্তই হয়ে উঠেছে ‘সোনার হরিণ’।
এই পরিস্থিতি নিরসনে নতুন নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে বলা হয়েছে, করোনার টিকা গ্রহীতারা প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ২৮ দিন পর রক্ত দিতে পারবেন। তবে অতি জরুরি প্রয়োজন, রক্তের অভাবে জীবননাশ বা জীবন সংশয়, নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ বা দুষ্প্রাপ্য রক্তের গ্রুপের ক্ষেত্রে কোভিড–১৯ টিকা গ্রহীতারা ১৪ দিন পর রক্ত দিতে পারবেন।
দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে এবং কোভিডের সময় রক্ত দেওয়া–নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশয় দূর করাই এ নির্দেশনা জারির উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট–এর ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার–ডিপিএম (নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচি) ডা. আতাউল করিম বলেন, প্রতিবছর আমাদের প্রায় নয় লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। যার একটি বড় অংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জীবন বাঁচাতে নিয়মিত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে।
এছাড়াও রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগী। তাদেরও প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোয় নিয়মিত সার্জারি এবং প্রসূতি মায়েদের জন্য রক্ত লাগে। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর থেকে রক্তের প্রাপ্যতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল এবং বিভিন্ন পর্যায়ের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রও রক্ত সংগ্রহ নিয়ে নানা মতভেদ সৃষ্টি হয়। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং এ সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতেই এ নির্দেশনা জারি করা হলো। আশা করছি, এ নির্দেশনার পর থেকে রক্ত পরিসঞ্চালন নিয়ে কারও কোনো সংশয় থাকবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ২৬ এপ্রিল এ সংক্রান্ত নির্দেশনা বিজ্ঞপ্তি আকারে স্বাক্ষর করেন। সেখানে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে রক্ত পরিসঞ্চালন সেবায় যথাযথ সুরক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এ নির্দেশনা জারি করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না–দেওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে। এতে বলা হয়েছে : ১. সব ধরনের করোনা টিকা গ্রহীতারা প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ২৮ দিন পর রক্ত দিতে পারবেন। তবে অতি জরুরি প্রয়োজন, যেমন: রক্তের অভাবে জীবননাশ বা জীবন সংশয়, নেগেটিভ রক্তের গ্রুপ বা দুষ্প্রাপ্য রক্তের গ্রুপের ক্ষেত্রে কোভিড–১৯ টিকা গ্রহীতারা ১৪ দিন পর রক্ত দিতে পারবেন। ২. কোভিড–১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি করোনা পরীক্ষা নেগেটিভ বা সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার ২৮ দিন পর রক্ত দিতে পারবেন। ৩. কোভিড–১৯ টিকা গ্রহীতা যেকোনো সুস্থ–সবল রক্তদাতা থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে পারবেন।
তবে, এমআরএনএ প্রযুক্তির করোনা টিকা, নন–রেপ্লিকেটিং এবং ইনঅ্যাকটিভেটেড প্রযুক্তির টিকার ক্ষেত্রে ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্লাড ব্যাংক’ এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। এ প্রতিষ্ঠান বলেছে, এ ধরনের টিকা নেওয়ার পর রক্ত দিতে কোনো অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। শুধু লাইভ ভাইরাস প্রযুক্তির টিকার ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার পর ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ভিন্ন কথা। এ সংস্থাটি বলছে, এমআরএনএ প্রযুক্তির করোনা টিকা, নন–রেপ্লিকেটিং এবং ইনঅ্যাকটিভেটেড প্রযুক্তির টিকার ক্ষেত্রে গ্রহণের সাত দিন পরে রক্ত দেওয়া যাবে। এ ছাড়া লাইভ ভাইরাস প্রযুক্তির টিকার ক্ষেত্রে ২৮ দিন পর রক্ত দেওয়া যাবে।
এ ছাড়া টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। যদি কেউ করোনা পজিটিভ হন, তাহলে নেগেটিভ হওয়ার ২৮ দিন পর টিকা নেওয়া যাবে। একইভাবে কেউ যদি প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার পর কোভিড–১৯ আক্রান্ত হন, তাহলে নেগেটিভ হওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ, কমপক্ষে ভাইরাসের দুটি ইনকিউবেশন পিরিয়ড পর টিকা নেওয়াই ভালো।
এর আগে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সভাপতিত্বে এ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে তাদের মতামত দেন। প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত এবং সভায় সংযুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩ থেকে ৪ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে। এদের মধ্যে যারা বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর তাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে প্রতিমাসে নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। কিন্তু দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। এর সঙ্গে যোগ হয় নানা ধরনের সংশয়। সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক কয়েকশ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন হয় সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের জন্য। কিন্তু কোভিডকালে এ হার অনেকটাই কমে এসেছে। তবে নিউরো, স্পাইন, হৃদরোগজনিত অস্ত্রোপচার এবং প্রসূতি মায়েদের জন্য রক্তের চাহিদা থেকেই গেছে। কিন্তু করোনাকালীন রক্ত সংগ্রহ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
এ টি