করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশের ৪০টি জেলা ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে কোভিড–১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বলেছে, ৫০টির বেশি জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ করা গেছে। দেশে করোনার ডেলটা ধরনের সামাজিক সংক্রমণ চিহ্নিত হয়েছে। এই ধরনের সংক্রমণক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন এনবি নিউজকে বলেন, ‘গত কয়েক দিনে শনাক্তের হার ২০ শতাংশ বা এর আশপাশে ছিল। সংক্রমণ নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ঘনীভূত নয়। সংক্রমণ লাফ দিয়ে বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করলে দুই বা তিন সপ্তাহ পরে সংক্রমণ কমে আসবে বলে আশা করা যায়।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার রূপান্তরিত চারটি ধরনকে উদ্বেগের কারণ বলে বর্ণনা করেছে। এগুলো হচ্ছে আলফা (উৎপত্তি যুক্তরাজ্যে), বিটা (দক্ষিণ আফ্রিকা), গামা (ব্রাজিল) ও ডেলটা (ভারত)। এর মধ্যে আলফা, বিটা ও ডেলটা ধরন বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছে। তিনটি ধরনেরই সংক্রমণ করার ক্ষমতা বেশি। এদের মধ্যে আলফা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগের লক্ষণ তীব্র হওয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তাই তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনও বেশি।
এদিকে হাসপাতালেও করোনা রোগীদের জন্য শয্যা কমে আসছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালে গতকাল কোনো আইসিইউ শয্যা খালি ছিল না। সাধারণ শয্যার ওপরও চাপ বেড়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গতকাল শয্যার চেয়ে বেশি করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক এই প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন দিনে ওই হাসপাতালের বহির্বিভাগে কোভিড–১৯ উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। একইভাবে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। দুই ডোজ টিকা নেওয়া একাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। এমন রোগীর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তাও জানিয়েছেন।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের ছয়টি অঞ্চলের করোনা সংক্রমণের রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রতি সপ্তাহে প্রকাশ করে। সর্বশেষ বিশ্লেষণ বলছে, ফেব্রুয়ারির পর গত সপ্তাহে নতুন আক্রান্ত সবচেয়ে কম ছিল। চারটি অঞ্চলে সামগ্রিকভাবে সংক্রমণ কমেছে। বেড়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকা অঞ্চলে। প্রতিটি অঞ্চলের তিনটি করে দেশের তথ্য দেওয়া হয়েছে।
আফ্রিকা অঞ্চলে এক সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে যথাক্রমে ৩৯ ও ৩৮ শতাংশ। সংক্রমণ বেড়েছে, এমন দেশের তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, উগান্ডার নাম রয়েছে। এই তিন দেশে মৃত্যুও বেড়েছে। তবে এক সপ্তাহে উগান্ডায় মৃত্যু বেড়েছে ৩১৪ শতাংশ। আমেরিকা অঞ্চলে ব্রাজিল ও কলম্বোতে নতুন রোগী ও মৃত্যু বেড়েছে। অন্যদিকে সংক্রমণ ও মৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে আর্জেন্টিনায়।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। ইরানে সংক্রমণ বেড়েছে ১১ শতাংশ, মৃত্যু কমেছে ৩ শতাংশ। ইরাকে সংক্রমণ বাড়লেও কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। অন্যদিকে এক সপ্তাহে ৫৬ শতাংশ মৃত্যু বেড়েছে আফগানিস্তানে।
বৈশ্বিক গড় পরিস্থিতির সঙ্গে ইউরোপীয় অঞ্চলের মহামারি পরিস্থিতির মিল দেখা যাচ্ছে। এক সপ্তাহে এ অঞ্চলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমেছে যথাক্রমে ৬ ও ১২ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য হারে সংক্রমণ বেড়েছে রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে, আর কমেছে তুরস্কে। মৃত্যু বেড়েছে রাশিয়ায়, কমেছে জার্মানি ও তুরস্কে।
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্যভাবে সংক্রমণ বেড়েছে মঙ্গোলিয়াতে, কমেছে ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়াতে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কমেছে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও জাপানে।
দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে এক সপ্তাহে সংক্রমণ কমেছে ২১ শতাংশ এবং মৃত্যু কমেছে ২৬ শতাংশ। এ অঞ্চলে বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারে সংক্রমণ বেড়েছে, আর কমেছে ভারতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন ধরন আসতে থাকবে। আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা—যে ধরনই হোক না কেন, এদের সংক্রমণ রোধে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন েএনবি নিউজকে বলেন, ‘টিকার অপেক্ষায় না থেকে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, নিয়মিত সাবানপানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।’