এনবি নিউজ : অশ্রুঝরা ১৫ আগস্ট আজ। বাঙালির কান্নার দিন। জাতীয় শোক দিবস। বাংলার ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হওয়ার দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, আবহমান বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য এবং তাদের পেছনের ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কলেপন করেছিল। বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের অন্তিম এই দিনে বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল রক্ত।
বাংলার ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো বিশাল বঙ্গবন্ধুর বুক থেকে রক্তগোলাপের মতো লাল রক্ত ঝরেছিল ঘাতকের বুলেটে। রাজনীতির সঙ্গে সামান্যতম সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও ঘৃণ্য কাপুরুষ ঘাতকচক্রের হাত থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নারী-শিশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও প্রাণ হারান তার সহধর্মিণী, তিন ছেলেসহ ১৮ জন সদস্য। বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে একাত্তরের পরাজিত শক্তি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বাঙালি জাতিসত্তাকেই ধ্বংস করতে চেয়েছিল। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে জন্ম নেওয়া দেশটিকে। সেদিন ঘাতকরা হত্যা করেছিল পিতার নশ্বর শরীরকে; কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্বকে বিনাশ করার। সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক তার ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;/তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-/চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।’ গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিনে আংশিক কলঙ্কমুক্ত বাঙালি জাতি আজও গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় ১৫ আগস্টের শহিদদের স্মরণ করবে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস ও জাতির পিতার ৪৬তম শাহাদতবার্ষিকী পালনে সারা দেশে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে করোনা সংকটময় এ মুহূর্তে দেশবাসীর পাশে দাঁড়াতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন। তাই আমাদের দায়িত্ব হবে জ্ঞান-গরিমায় সমৃদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। তাহলেই চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি : সরকার যথাযথ মর্যাদায় ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশ ও প্রবাসে জাতীয় শোক দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, এদিন সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণ, সশস্ত্রবাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত করা হবে। ১৫ আগস্টে শাহাদতবরণকারী জাতির পিতার পরিবারের সদস্য ও অন্য শহিদদের কবরে (ঢাকার বনানী কবরস্থানে) সকাল সাড়ে ৭টায় পুষ্পস্তবক ও ফুলের পাপড়ি অর্পণ এবং দোয়া ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে ফাতেহা পাঠ, প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণ, সশস্ত্রবাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত ও বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
সারা দেশের মসজিদে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক সময়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন দিবসটির অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। পোস্টার মুদ্রণ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/গ্রোথ সেন্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার সাঁটানো ও এলইডি বোর্ডের মাধ্যমে প্রচারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শোক দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সব মোবাইল গ্রাহককে খুদে বার্তা প্রেরণ করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিশু একাডেমি বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর জাতীয় শোক দিবস ও বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক বক্তৃতার আয়োজন করবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, তথ্য ও সম্প্রচার, ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ, মহিলা ও শিশু, সমাজকল্যাণ ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থা জাতীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলোচনাসভা, শোক দিবসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কবিতা পাঠ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চিত্রপ্রদর্শনী, হামদ-নাত প্রতিযোগিতা এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল আয়োজন এবং জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে সংগতি রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। শোক দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজনে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। জেলা-উপজেলায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত কর্মসূচিতে জেলা পরিষদ ও পৌরসভার অংশগ্রহণসহ দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে সংগতি রেখে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতপূর্বক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বাস্তবায়ন করবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয়ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে এবং আলোচনাসভার আয়োজন করা হবে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : সূর্য উদয়ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে সংগঠনের সব স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে ৮টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবে দলটি। এছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনসহ মহানগরের প্রতিটি শাখার নেতাকর্মীরা যথাযথভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে বনানী কবরস্থানে আগস্টের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। বেলা ১১টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল এবং গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলার নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং সুবিধামতো সময়ে মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে। দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে। বাদ আসর বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
টুঙ্গিপাড়া সমাধি কমপ্লেক্সে কর্মসূচি : গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, টুঙ্গিপাড়ায় সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ সময় সশস্ত্রবাহিনীর একটি চৌকশ দল গার্ড অব অনার প্রদান করবে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব সেখানে ফাতেহা পাঠ ও বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টে নিহত শহিদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেবেন। পরে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরপর জেলা প্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
এ টি