• বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন

নোয়াখালী কারাগার যেন একরামের রাজপ্রাসাদ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
আপডেটঃ : শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সংবাদটির পাঠক ১,৩৩৭ জন

 

কারাগারে বন্দি তিনি। যেনতেন বন্দি নন। ভিআইপি বন্দি। পেয়েছেন ডিভিশনও। কিন্তু তার পক্ষে জরাজীর্ণ কারাগারে থাকা কীভাবে সম্ভব? তাই তো তিনি কারাগারের নিজের ভিআইপি রুমে টাইলস বসিয়েছেন। লাগিয়েছেন এসি। রাত নেই, দিন নেই; তার লোকজন সাক্ষাৎ করছেন। কারাগারের খাবার কি খাওয়া যায়? না এই ভিআইপি’র পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই তো বাইরে থেকে নিয়মিত তার খাবার যাচ্ছে। এসবই কারাগার আইনের লঙ্ঘন। শুধু তাই নয়, গত কোরবানি ঈদে জেলে থাকা ৭৭০ জন কয়েদি ও বন্দিকে উপহার দিয়েছেন ১০০০ টাকা করে। ঈদে দু’টি বিশাল সাইজের গরু এনে খাইয়েছেন সবাইকে। কারারক্ষী থেকে কয়েদি এমনকি কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার অনুগত। এক সময় নোয়াখালী জেলা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এখনো কারাগারে বসে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর পুরো কারাগারের নিয়ন্ত্রণ তো তার হাতেই। এসব অভিযোগে একবার তাকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু বেশিদিন সেখানে থাকতে হয়নি। ফের ফিরে এসেছেন নোয়াখালী কারাগারে। এতসব কাণ্ড যিনি করছেন তিনি হলেন- নোয়াখালী-৪ অর্থাৎ সদর আসনের চারবারের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী। কারাগারে টাইলস ও এসি লাগানোর ব্যাপারে কথা হয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম রুবেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, টাইলস লাগিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ। আর এসি লাগানোর বিষয়টি ঠিক নয়। আর কোনো তথ্য জানার থাকলে জেল সুপারের কাছ থেকে জেনে নিবেন। তিনি এখন সিঙ্গাপুর আছেন। ট্রেনিংয়ে গেছেন। তিনি আসলে তার সঙ্গে কথা বলে নিবেন। জেলারের কাছে জানতে চাওয়া হয় শহরের সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে জেল সুপার সিঙ্গাপুর গিয়েছেন বেড়াতে। আর একরাম চৌধুরীর টাকায় তিনি সস্ত্রীক গেছেন। সঙ্গে একরাম চৌধুরীর স্ত্রীও গেছেন। জেলার রুবেল বলেন, এসব সত্য নয়। তাছাড়া আমি এখান থেকে বদলি হয়ে যাচ্ছি কুমিল্লায়। নোয়াখালী কারাগারে কতোদিন আছেন? তিনি জানান, মাত্র দশ মাস। এত অল্প সময়ে কেন বদলি করা হয়েছে বুঝতে পারছি না।

ওদিকে টাইলস লাগানোর ব্যাপারে জেলার গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে কথা বললেও নেয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মানবজমিনকে জানান, টাইলস লাগানোর সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগ জড়িত নয়। আমরা এ ব্যাপারে জানিও না। এ ব্যাপারে কারাগারের উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) রেজাউল করিম রাজু জানান, গত দুই বছরে কারাগারে কোনো কাজ করেনি গণপূর্ত। টাইলস বা এসি লাগানোর বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ কিছুই জানে না।

সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী ২০০৮ থেকে চার বারের এমপি। দীর্ঘ এই সময়ে তিনি নোয়াখালীতে তৈরি করে নেন নিজস্ব বলয়। জেলা জুড়ে ছিল তার কিশোর গ্যাং বাহিনী। ছিল আলাদা আলাদা গ্রুপও। যারা একরামের নির্দেশে খুন, রাহাজানি থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই করেনি। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার পাশের আসনের এমপি। ওবায়দুল কাদেরও তাকে সমঝে চলতেন বলে মানুষের মুখে মুখে। একবার ওবায়দুল কাদেরের ভাই বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান মির্জা কাদেরের সঙ্গে একরাম চৌধুরীর বাকযুদ্ধ গোটা দেশে আলোচনার বিষয় হয়। সে সময় একরামুলসহ ৯৬ জনের বিরুদ্ধে কাদের মির্জা জিডিও করেছিলেন। কোম্পানীগঞ্জ থানায় করা জিডিতে একরামসহ আসামিদের বিরুদ্ধে তাকে ও তার নেতাকর্মীদের হত্যা ও লাশ গুমের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন।

জিডিতে আবদুল কাদের মির্জা উল্লেখ করেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তিনি চিকিৎসার জন্য আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে গোপন সূত্রে জানতে পারেন, আমেরিকার স্থানীয় সময় রাত ১০টায় আমেরিকায় ৮ নম্বর আসামি আল-আমিনের বাসায় ৭-১৫ নম্বর আসামি এবং ৬ই জুন বাংলাদেশ সময় সকাল আটটায় নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার সুন্দলপুরে এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে তার বাসায় মিজানুর রহমান, ফখরুল ইসলাম ও মাহবুবুর রশিদ ওরফে মঞ্জু, খিজির হায়াত খান, আ জ ম পাশা চৌধুরী ওরফে রুমেল গোপন বৈঠক করেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, গোপন বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকায় গেলে তাকে সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের ভাড়া করে হত্যার পর লাশ গুম করা হবে এবং দেশে তার ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও তাদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করা হয়। এ জন্য দুই কোটি টাকা খরচের বাজেট করা হয়। ওদিকে কাদের মির্জাকে ‘পীর সাহেব নামধারী বদমাইশ’ বলে আখ্যা দেন একরামুল করিম চৌধুরী। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আমাকে নিরপেক্ষভাবে একটা দিন সময় দেন। আমি কাদের মির্জার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। কারণ, এ বদমাইশ ভাইয়ের নাম করে আবার ভাইকেই অপমান করে।’

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ ১৬ বছরে একরামুল করিম চৌধুরীর ইশারায় সব অপকর্ম চলতো নোয়াখালী শহরে। কোনো ভিন্নমতের জায়গা ছিল না। বরং বিরোধী মত দমন করে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেন সাবেক এই এমপি। পাশাপাশি নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পরিবারের সদস্যদেরও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে বসান। এ ছাড়া নিজের প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রী শিউলী একরামকে কবিরহাট উপজেলা পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান বানান। ভাগ্নে জহিরুল হক রায়হানকে বানান কবিরহাট পৌরসভার মেয়র। ভাগ্নে রায়হান বিএনপি নেতা ছিলেন। মামা একরাম তাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে পৌরসভার মেয়র পদ পুরস্কার দেন। অপরদিকে একরাম তার পুত্র সাবাব একরামকে বানান সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।

এই সাবাবও বিতর্কিত বহু কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ২০১৮ সালের জুন মাসে রাজধানীর মহাখালীতে সাবাবের গাড়ির ধাক্কায় সেলিম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। পরে ৩০ লাখ টাকায় এ ঘটনা সমঝোতার অভিযোগ উঠে একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে কবিরহাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সময় মায়ের প্রতিপক্ষ প্রার্থী আলাবক্স তাহের টিটুর অনুসারীদের ওপর গুলি চালানো হয় সাবাবের নেতৃত্বে। স্বামী এমপি, স্ত্রী ও পুত্র দু’টি উপজেলার চেয়ারম্যান। তাদের আর রুখে কে? একরামের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকাকালে টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই তিনি করেননি। আর এভাবেই হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু রিপোর্ট ছাপা হয়েছে।

কিন্তু এভাবে যে একরামের দুর্গ ধসে পড়বে তা কে জানতো? কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে একদফার আন্দোলন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়ন তছনছ করে দেয় সবকিছু। পালিয়ে যান একরাম চৌধুরীও। এর দুই মাস পর চট্টগ্রামের খুলশি থানাধীন আবদুল মালেক লেন এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপরই নোয়াখালী কারাগারে নিয়ে আসা হয়। কারাগার সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে তৈরি হওয়া এ কারাগারে তিনটি ভিআইপি রুম রয়েছে। ডিটেনশনপ্রাপ্তদের সেখানে রাখা হয়। সেখানকার একটি রাজকীয় রুমই দিয়েছেন একরামুল করিম চৌধুরীকে। যেখানে বসে তিনি এখনো নোয়াখালীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজ করছেন।

নোয়াখালী কারাগারে আনার পর তাকে আদালতে হাজির করলে হাতকড়া লাগানো হতো না। ভিআইপি মর্যাদায় তাকে আদালতে নেয়া হতো। এভাবে একাধিকবার আদালতে নেয়া হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এ নিয়ে প্রতিবাদ জানান। এরপর থেকে তাকে এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নেয়া হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ পর্যন্ত একরামুল করিম চৌধুরীর জামিন আবেদন করা হয়নি আদালতে। এ নিয়ে নোয়াখালীতে নানা কানাঘুষা চলছে।

অতি সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হয়েছেন রিয়াদ নামের এক রাজনৈতিক কর্মী। তিনি সাবেক এমপি একরাম চৌধুরীর ব্যাপারে বলেন, ওনার রুম তো রুম নয়। যেন কারাগারে এক বেহেশত খানা। একরাম সাব যে আসামিই বের হয়ে আসেন তাকে ১০০০ টাকা করে দেন। এ ছাড়া মাঝে মধ্যেই গরু জবাই করে খাওয়ান। জরাজীর্ণ এ কারাগারের ধারণক্ষমতা ৫০০ জনের। কিন্তু বর্তমানে বন্দি রয়েছে ৭৯৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৭৭৯ জন। মহিলা ১৯ জন।


এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১  

নামাজের সময় সূচি

    Dhaka, Bangladesh
    বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫
    ওয়াক্তসময়
    সুবহে সাদিকভোর ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ
    সূর্যোদয়ভোর ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ
    যোহরদুপুর ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ
    আছরবিকাল ৩:০৩ অপরাহ্ণ
    মাগরিবসন্ধ্যা ৫:৩২ অপরাহ্ণ
    এশা রাত ৬:৪৭ অপরাহ্ণ