বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন ১৩২০ মেগাওয়াটের ‘এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে’ শনিবার সকালের এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচ শ্রমিক মারা গেছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে আরও ১৭ জন শ্রমিক ও তিন পুলিশ সদস্য।
শ্রমিকদের ভাষ্য, পুলিশ তাদের তাদের বিক্ষোভে ‘বিনা উসকানিতে’ গুলি চালিয়েছে। বিপরীতে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকের ‘হামলার মুখে বাধ্য হয়ে’ গুলি চালাতে হয়েছে তাদের।
কয়েকটি শ্রমিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ‘এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট’ প্রকল্পের কাজে চুক্তিভিত্তিক, স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের বেশিরভাগই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা; স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক কম।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে বাংলাদেশি ও চীনা মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছে। সেখানে দিনে-রাতে মিলিয়ে কয়েক পালায় কাজ চলে। প্রকল্প এলাকার ভেতরেই শ্রমিকদের থাকায় জায়গা।
প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকরা জানান, বকেয়া বেতন ও রমজানে কাজের সময় পরিবর্তন ও ছুটির দাবিতে ‘অস্থায়ী শ্রমিকরা’ শুক্রবারের পর শনিবার সকালে আবার বিক্ষোভ করে। পুলিশ এসে শ্রমিকদের ‘দাবি মানা হবে’ বলে আশ্বাস দিলেও তারা মানেনি।
শনিবারের বিক্ষোভে অংশ নেন মূলত বাঁশখালীর বাসিন্দা ‘অস্থায়ী শ্রমিকরা’, যাদের ‘চাপে’ স্থায়ী শ্রমিকরাও বিক্ষোভ যেতে ‘বাধ্য হয়েছেন’ বলে দাবি করেছেন একাধিক স্থায়ী শ্রমিক।
বকেয়া বেতন ও কাজের সময় নিয়ে বিক্ষোভ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন বাঁশখালী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু সাইদ (৫৪) প্রকল্পের নিরাপত্তা কর্মী।
এনবি নিউজকে তিনি বলেন, “বকেয়া বেতন আর রমজান মাসে নামাজ ও তারাবির সময় পরিবর্তন নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। আমি বিক্ষোভে যাইনি, দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। পুলিশ গুলি করলে আমার গায়ে লাগে।”
প্রকল্পের স্থায়ী শ্রমিক নোয়াখালী প্রিয়তম সুত্রধর বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন। গুলিবিদ্ধ এক শ্রমিককে নিয়ে তিনি হাসপাতালে আসেন।
প্রিয়তম বলেন, তাদের মার্চের মাসের বেতন এখনো দেয়নি। নামাজ, সেহরি ও ইফতারের সময় নিয়ে অস্থায়ী শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। তারাই আজকে আমাদের বিক্ষোভে যেতে বাধ্য করে।”
সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হয়েছেন হাতিয়ার বয়ার চর এলাকার রায়হান। তার দুই চাচাত ভাই আবদুর রহমান ও মিরন হোসেন রকিও একসাথে প্রকল্পে ক্রেন অপারেটরের কাজ করতেন।
মিরন এনবি নিউজকে বলেন, “রায়হান আন্দোলনে যায়নি, সে মূল প্ল্যান্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আর রকি ক্রেন চালাচ্ছিল। আন্দোলনকারীরা গাড়ি বন্ধ করে মিছিলে যেতে বললে আমরা যাই। তখন পুলিশ গুলি করলে রায়হানের গায়ে লাগে।”
পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করেছে বলে তার অভিযোগ।
বাঁশখালীর গন্ডামারার অস্থায়ী শ্রমিক তৌহিদ (২৪) এনবি নিউজকে বলেন, শ্রমিকরা নামাজ ও ইফতারের সময় ছুটির দাবি করেছিল। শুক্রবার সকালেও আন্দোলন করে। আর রোজা শুরুর আগে গতমাসের বেতন দিতে বলেছিল।“শুক্রবার কর্তৃপক্ষ বলেছিল দাবি মেনে নিবে। এরপর আর কালকে আন্দোলনাকারীরা কাজে যায়নি। তারা লিভিং এরিয়াতে চলে যায়।”
এরপর শনিবার সকালে কাজে যোগ দিতে বলে পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। এরপরও শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
সিলেটের শ্রমিক শামসুল হক বলেন, তাকেও স্থানীয় শ্রমিকরা শনিবার বিক্ষোভে যেতে বাধ্য করে। পরে গুলিতে তার সঙ্গী আমিনুল হক আহত হয়।
গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির কন্সটেবল ইয়াসির চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বলেন, “কয়েক হাজার শ্রমিক এসে হামলা করে ফাঁড়িতে। আমি মুখে ও চোখে আঘাত পেয়েছি।”
হাসপাতালে তিন পুলিশসহ মোট ২০ জন আহত চিকিৎসাধীন আছে। তাদের মধ্যে ১৭ শ্রমিকের সবাই গুলিবিদ্ধ। আর শ্রমিকদের ছোড়া ইটে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত আছে পুলিশ সদস্যদের।
‘আত্মরক্ষার্থে গুলি’
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) কবির আহমেদ এনবি নিউজকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শুক্রবারও বিক্ষোভ করে। এর ধারাবাহিকতায় শনিবার সকালেও তারা জড়ো হয়ে প্ল্যান্টের বাইরে বিক্ষোভ করে।
এতে স্থানীয় কিছু লোকজনেরও সম্পৃক্ততা ছিল দাবি করে তিনি বলেন, একপর্যায়ে তারা উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এসময় পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছোঁড়ে।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের হামলায় গুরুতর আহত তিন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এনবি নিউজকে বলেন, “এখানে অনেকগুলো গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। অনেক ভাঙচুর করা হয়েছে। পুলিশের উপর আক্রমণ করেছে। শ্রমিকদের কিছু দাবি দাওয়া ছিল যেগুলো নিয়ে এক ধরনের অসন্তোষ ছিল সেটা থেকে আজকের এই ঘটনাগুলো ঘটেছে।
“এটা আরও বিস্তারিত দেখার জন্য জেলার ডিসি মহোদয়, আমাদের পুলিশ সুপার, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মালিকপক্ষের লোকজনকে নিয়ে একসাথে বসে সমাধান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করেছি।”
‘বিনা উসকানিতে’ গুলি ছোড়ার অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, “পুলিশের ১০টা গাড়িতে আগুন দিয়েছে। পুলিশের উপর আক্রমণ করেছে। আত্মরক্ষার স্বার্থে জীবনরক্ষার স্বার্থে একটা পর্যায়ে পুলিশের আর গুলি করা ছাড়া উপায় থাকে না।”
বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপ এস আলম গ্রুপের ৭০ শতাংশ এবং চীনা কোম্পানি সেফকোথ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
এস আলম গ্রুপের মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এগুলো হল- এস আলম স্টিলস, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল, এস আলম সিমেন্ট লিমিটেড, সোনালি কার্গো লজিস্টিকস লিমিটেড এবং জেনেসিস টেক্সটাইল এক্সেসরিজ অ্যান্ড এপারেলস লিমিটেড।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকোথ্রির প্রতিনিধি টান জে লিং।
‘উসকানি’ দেখছে এস আলম
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের পক্ষে তার ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন এনবি নিউজকে বলেন, “চায়নিজ প্রতিষ্ঠানই বাঁশখালীর ওই পাওয়ার প্ল্যান্টটি তৈরি করে দিচ্ছে। সেখানে চায়নিজ ছাড়াও বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছে।
“চায়নিজ কর্তৃপক্ষ কর্মরত বাঙালি শ্রমিকদের নিয়মিত বেতনভাতা দিয়ে আসছে। কিন্তু শুক্রবার কিছু শ্রমিক বেতন বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে এবং চায়নিজ কর্তৃপক্ষের ওপর বারবার চাপ দিতে থাকে।”
অতীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘বিপক্ষে থাকা’ কিছু লোকের ইন্ধনে শনিবারে এ ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ করে আকিজ উদ্দিন বলেন, “তারা উসকানি দিয়ে এ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটিয়েছে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে।”
প্রকল্পের কাজের শুরুতে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয়দের বিক্ষোভে গুলি চালানো হলে চারজন নিহত হয়।সেই ঘটনার উল্লেখ করে আকিজ বলেন, “শনিবারের ঘটনাও আগের ঘটনার সূত্র ধরেই ঘটানো হয়েছে।”
তবে সেই ‘কিছু লোক’ কারা- এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য দেননি তিনি।
ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী বছরের জুন মাস নাগাদ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যেতে পারবে বলে জানান এস এস পাওয়ার প্ল্যান্টের চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) এবাদত হোসেন।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রশাসনসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে হওয়া বৈঠকে তাদের দাবি মানাসহ হতাহতদের বিভিন্ন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নিহত প্রত্যেক পরিবারকে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে সহযোগিতা দেওয়া হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষ থেকে।