এনবি নিউজ : বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ৩ কোটির বেশি টেলিভিশনের (টিভি) কেবল সংযোগ (নেটওয়ার্ক)। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এসব সংযোগ ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় না আনলে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা আগেই জানিয়েছে সরকার। হাতে আছে মাত্র সাত দিন। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের ডিজিটাল করার পদ্ধতি সেট টপ বক্স পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কেবল ও ফিড অপারেটররা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে বর্তমানে বাজারে ৩ কোটি ৮০ লাখের বেশি ডিশ সংযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ গ্রাহকের সংযোগ ডিজিটাল। বাকি ৯৭ শতাংশ গ্রাহক অ্যানালগ। এই অবস্থায় গ্রাহকরা আশঙ্কায় রয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, টিভি নেটওয়ার্ক অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাচ্ছেন না। বাজারে পর্যাপ্ত সেট টপ বক্সও নেই। কিছু বক্স পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ৩১ অক্টোবর বলেছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের গ্রাহকদের সেট টপ বক্স বসাতে হবে। বাকি বিভাগীয় শহরের জন্য এই সময়সীমা বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তা না থাকলে টিভি দেখতে সমস্যা হবে বলে বলেছেন মন্ত্রী।
এদিকে কেবল অপারেটররা বলেছেন ইতোমধ্যে সংযোগ ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের প্রান্তে ডিজিটাল নেটওয়ার্ক স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। এখন গ্রাহকদের দায়িত্ব সেট টপ বক্স নিয়ে ডিজিটাল সংযোগ চালু করা। কিন্তু তাদের আশঙ্কা-বাজারে সেট টপ বক্সের এতটাই সংকট যে এই সময়ের মধ্যে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
কেবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, সেট টপ বক্সের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, এ বিষয়ে এখনো পরিকল্পনা করা হয়নি। সরকার কী পলিসি দেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছি আমরা। তিনি জানান, ৯৫ শতাংশ সেট টপ বক্স চীন থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে কোনো সেট টপ বক্স প্রস্তুত হয় না। করোনা মহামারির কারণে চীনে এখনো ফ্যাক্টরিগুলো পুরোপুরি চালু হয়নি। কাজেই এই অল্প সময়ে এটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
গ্রাহকদের কিস্তিতে সেট টপ বক্স দেওয়ার কথাও বলেছেন তথ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে আনোয়ার পারভেজ বলেন, আমরা অনেক ধরনের পরিকল্পনা করছি। কিন্তু এখনো সমুদ্রের মধ্যে আছি। কিনারা পাচ্ছি না। কিছুই চূড়ান্ত করতে পারিনি। তিনি বলেন, গ্রাহকদের কিস্তিতে সেট টপ বক্স দিতে গেলে ৩-৪ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। এটা মুখের কথা নয়। কাজটা কীভাবে করা হবে, সেটাও ঠিক করা যায়নি। বর্তমানে বাজারে দেড় হাজার থেকে চার হাজার টাকায় সেট টপ বক্স পাওয়া যায়। এগুলো শুধু কোয়াব সদস্যদের কাছ থেকে নিতে হবে নাকি বাজার থেকেও কেনা যাবে, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান তিনি। তবে বাজার থেকে কেনার ব্যবস্থা রাখা হলে গ্রাহকের জন্য সুবিধাজনক হবে বলে মনে করেন কোয়াব সভাপতি। তিনি আশা করছেন, সরকার এসব বিষয় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে তাদেরকে ১৮ মাস থেকে ২ বছর সময় দেবে। ফিড অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতারা বলেছেন, কেবল টিভি দেখতে সেট টপ বক্স বাস্তবায়ন করতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এজন্য কমপক্ষে আরও ছয় মাস সময় চায়। তারা জানান, ‘কোয়াব’ পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকারকে একতরফা পরামর্শ দিয়েছে। তারা ফিড অপারেটরদের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি। তারা কেবল অপারেটর এবং ফিড অপারেটর খাতকে ‘প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ারও দাবি জানান। ফিড নেটওয়ার্ক ডিজিটাল করার লক্ষ্যে ফাইবার অপটিকস অবকাঠামো স্থাপন এবং ডিজিটাল সেট টপ বক্সের জন্য ফিড অপারেটরদের ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার) খাদিজা বেগম বলেন, সরকার যেহেতু সব ক্ষেত্রকে ডিজিটালাইজ করছে, এর অংশ হিসাবে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদি গ্রাহকরা ৩০ নভেম্বর বা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে টিভিতে সেট টপ বক্স যুক্ত না করেন, তাহলে কেবল কানেকশন থাকবে কি না-এমন প্রশ্নে খাদিজা বেগম বলেন, যখন একটা সিস্টেম অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল করা হবে, তখন দর্শকদের সেই সিস্টেমের মধ্যে আসতে হবে। এটা বাধ্য করার কোনো বিষয় না।
কেবল সংযোগ ডিজিটাল হলে যে সুবিধা পাওয়া যাবে : সরকার এবং কেবল অপারেটর প্রতিনিধিরা বলেছেন, এই সুবিধা গ্রাহক অর্থাৎ দর্শক, সরকার ও কেবল অপারেটর সবাই পাবেন। গ্রাহকরা উন্নতমানের ছবি দেখতে পাবেন। বিদেশি চ্যানেলের ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান দেখতে পাবেন দর্শকরা। এছাড়া এই পদ্ধতিতে পছন্দমতো অনুষ্ঠান ও চ্যানেলের তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে একদিকে দর্শক তার পছন্দের অনুষ্ঠান বা চ্যানেল সহজেই দেখতে পারেন। অপরদিকে সরকারের রাজস্ব আদায় সহজ হবে।
সরকারের অনুমোদন ছাড়াই দেশে সম্প্রচারিত হচ্ছে তিন শতাধিক বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল। কেবল ও ফিড অপারেটররা এসব চ্যানেল বেআইনিভাবে সম্প্রচার করছেন। প্রতিটি চ্যানেল সম্প্রচারের ক্ষেত্রে তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এসব চ্যানেল পরিচালনার অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হচ্ছে টাকা।
দেশে অনুমোদিত চ্যানেল রয়েছে ১২৫টি। অথচ সম্প্রচারিত হচ্ছে প্রায় ৩৫০টি চ্যানেল। বাকি ২২৫টির মতো চ্যানেল বেআইনিভাবে চলছে। ফলে এ শিল্পে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত বছর নভেম্বরে দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে কেবল অপারেটররা বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেন। এর বড় অংশই করছেন অবৈধ চ্যানেলগুলো থেকে। এ আয়ের ওপর সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৩৫ শতাংশ করপোরেট করসহ বছরে ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পাওয়ার কথা। অথচ অপারেটররা দিচ্ছেন মাত্র ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা।
বাকি ১ হাজার ৯০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। যেহেতু বিদেশি মূল এজেন্ট দ্বারা ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রতি হচ্ছে, তাই আয়ের একটি বড় অংশই পাচার করে পাঠানো হচ্ছে মূল এজেন্টের কাছে। এ হিসাবে বছরে গড়ে লাইসেন্স ফি, দেশে বিজ্ঞাপন খাতে আয় বিদেশে পাঠানো ও বিদেশি বিজ্ঞাপনের অর্থ দেশে না আসায় এসব মিলে বছরে শত শত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।
কেবল নেটওয়ার্ক ডিজিটাল হলে কেবল অপারেটররাও সুবিধা পাবেন। যারা পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কেবল সংযোগ দেন, সেসব অপারেটরদের কাছ থেকে কোয়াব একটা তালিকা পাবে। কোয়াবের সভাপতি আনোয়ার পারভেজ বলেন, অনেকে আছেন যারা ২০টি বাসায় কেবল সংযোগ দেন; কিন্তু আমাদের বলেন ১০টা বাসা। এক্ষেত্রে সেটা তারা করতে পারবে না। কারণ সেট টপ বক্স নিলে অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হবে প্রক্রিয়াটি। সুতরাং কোন এলাকায় কতজন কেবল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন, তা আমরা জানতে পারব। তাই টাকা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
বর্তমানে দেশে দুটি প্রতিষ্ঠানের ডিটিএইচ (ডাইরেক্ট টু হোম) সেবাদানের অনুমতি আছে। বায়ার মিডিয়া লিমিটেড অনুমতি পেলেও সেবা এখনো চালু করেনি। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে সাড়ে চার লাখেরও বেশি আকাশ ডিটিএইচ ব্যবহারকারী রয়েছেন। যারা ডিটিএইচ সেবা ব্যবহার করেন, তাদের আলাদা করে সেট টপ বক্স কেনার প্রয়োজন নেই। তারা প্রথম থেকেই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিভি দেখছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করা এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখের বেশি কেবল টিভি সংযোগ চালু আছে। এ হিসাবে প্রতিমাসে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আয় করেন কেবল অপারেটররা। কিন্তু বৈধ পন্থায় এ আয় দেখা যায় না বলে এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না।