স্কুলে ভর্তির জন্য মেয়ে পিয়েতার জন্ম নিবন্ধন করাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ার কথা জানিয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী বাপ্পা মজুমদার।
তিনি বৃহস্পতিবার এনবি নিউজকে জানান, সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে গিয়ে জানতে পারেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেরও জন্ম নিবন্ধন করাতে হবে। সেটা করতে গিয়ে তিনি আরেক সমস্যায় পড়েছেন।
“বাচ্চার জন্ম নিবন্ধনের জন্য আমার জন্ম নিবন্ধন চাচ্ছে। আমার জন্ম নিবন্ধনের জন্য যখন আমি আবেদন করতে চাচ্ছি, সেখানে আমার বাবা-মার জন্মনিবন্ধন নম্বর চায়। সেটা ছাড়া আবেদনটা নিচ্ছে না। অথচ বাবা-মা মারা গেছেন অনেক দিন আগে, উনাদের জন্ম নিবন্ধন নাই।”
চল্লিশোর্ধ্ব বাপ্পা এই সমস্যার কথা জানালেও রেজিস্ট্রার জেনারেল মানিক লাল বনিকের দেওয়া তথ্য মতে, তার এই ভোগান্তিতে পড়ার কথা নয়।
স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ই দেশের নাগরিকদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমের দায়িত্বে রয়েছে।
নতুন নিয়ম সম্পর্কে মানিক লাল বনিক এনবি নিউজকে বলেন, “২০০১ সাল এবং তার পর থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্ম সনদ পেতে হলে আগে তার মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। আর ২০০১ সালের আগে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিলেই হয়।”
বাপ্পা মজুমদারের জন্ম সত্তরের দশকে হওয়ায় তার জন্ম নিবন্ধনের আবেদনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর চাওয়ার কথা নয়।
রেজিস্ট্রার জেনারেল জানান, নতুন নিয়মে যখন ২০০১ সাল ও তার পরে জন্ম নেওয়া কোনো শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য অনলাইনে আবেদন করা হয় তাতে মা-বাবার জন্ম নিবন্ধনের নম্বর দিতে হয়। সে কারণে বর্তমানে কোনো শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য বা-বাবার জন্ম নিবন্ধন থাকাটা আবশ্যক।
এই নিয়ম চালু হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ার কথা জানিয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এ গিয়ে কথা হয় বাড্ডার বাসিন্দা ফরহাদ উদ্দিনের সঙ্গে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে এসেছিলেন তিনি।
ফরহাদ এনবি নিউজকে বলেন, তাদের দুজনের জন্ম নিবন্ধন আছে। তবে একজনের ইংরেজিতে অন্যজনেরটা বাংলায় হওয়ার কারণে তারা আবেদনই করতে পারছেন না।
“নতুন এই সিস্টেম হওয়ার পর বিপদে পড়ছি। এখন বার্থ সার্টিফিকেট কেমনে করব বুঝতে পারছি না। এদিকে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
বিষয়টির ব্যাখ্যায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মী এনবি নিউজকে বলেন, সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের জন্য বাবা-মা দুজনের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বাবা ও মায়েরটা যদি বাংলায় হয় তাহলে সন্তান বাংলায় একটা জন্ম নিবন্ধন পাবে। আর দুটোই ইংরেজিতে হলে জন্ম নিবন্ধন পাবে ইংরেজিতে।“কিন্তু যদি দুজনেরটা আলাদা হয় তাহলে আবেদনই করতে পারবে না। দুজনেরটা এক ভাষায় করে নিতে হবে। এটা করলে সন্তান জন্ম নিবন্ধন নিতে পারবে। এ ধরনের সমস্যা অনেক হচ্ছে।”
মহাখালীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক সামিদুল এনবি নিউজকে জানান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে তার জন্ম নিবন্ধনের জন্য এসে বিপদে পড়েছেন।
তিনি এনবি নিউজকে বলেন, “পোলার কার্ড করতে গেলে আমারে বলছে আগে আমাগো দুইজনের জন্মনিবন্ধন লাগব। জাতীয় পরিচয়পত্র, বাড়িওয়ালার কাছ থেইক্কা অনুরোধ কইরা পানির বিলের কপি নিয়া জমা দিছি। আমাগোর নিবন্ধন হইছে, অহন পোলারডার লাইগা অপেক্ষায় আছি। এ মাসের মইদ্যে পোলার ইস্কুলে কার্ড দেওন লাগব। সিটি করপোরেশন কইছে ২৮ তারিখে দিয়া দিব।”
নতুন এই নিয়ম হওয়ায় শিশুদের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে বাবা-মায়ের ভোগান্তির পাশাপাশি প্রাথমিকের সব শিশুকে উপবৃত্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবি নিউজকে বলেন, “আমার বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রায় ২০০ জন। এর মধ্যে গত দেড় মাসে ৩০ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন হয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকারের উপবৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীর জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই বহু বাচ্চার বাবা-মা ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে নিজেদের জন্ম সনদ না থাকায় বাচ্চার জন্ম নিবন্ধন না করেই ফিরে আসতে হচ্ছে।”
মাঠ থেকে ভোগান্তির খবর এলেও রেজিস্ট্রার জেনারেল মানিক লাল বনিক বলছেন, ভোগান্তি নয়, জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যু নিবন্ধনে শৃঙ্খলার জন্যই এমন নিয়ম করা হয়েছে।
“পাসপোর্ট করা, বিবাহ নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমি রেজিস্ট্রেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সকলের জন্ম সনদ প্রয়োজন। সবাই যেন জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আসেন সেই জন্য নিবন্ধনের আবেদনে কিছু বিষয় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
জন্ম নিবন্ধনের আবেদন করতে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভারে বছরের শুরুতে চাপ বেশি থাকার কারণে কিছু দিন বিড়ম্বনা থাকলেও এখন ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে না’ বলে দাবি করেন তিনি।
মানিক লাল বলেন, “বছরের শুরুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির একটা বিষয় থাকে, তখন জন্ম নিবন্ধন করার একটু চাপ থাকে। যেহেতু অনলাইনে এই নিবন্ধন করতে হয় বছরের শুরুতে এই সার্ভারে একটু সমস্যা হয়েছিল। তবে এখন আর সেই ধরনের কোনো সমস্যা নেই।”
বয়স ভেদে জন্ম নিবন্ধনের জন্য যেসব তথ্য ও নথি দরকার হবে সেগুলো নিচে তুলে ধরা হল-
শুন্য থেকে ৪৫ দিন বয়সী শিশুর জন্ম নিবন্ধনের জন্য
>> টিকার কার্ড
>> পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র
>> বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাক্সের রশিদের হাল সনদ
>> আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর
>> ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি
৪৬ দিন থেক ৫ বছর বয়সীদের জন্ম নিবন্ধন নিতে
>> টিকার কার্ড/স্বাস্থ্যকর্মী প্রত্যয়নপত্র স্বাক্ষর ও সিলসহ প্যাডে হতে হবে
>> পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র
>> প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নসহ বিদ্যালয়ের প্রত্যয়নের সব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট লাগবে
>> বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাক্সের রশিদের হাল সনদ
>> আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর
>> ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি।
বয়স ৫ বছরের বেশি হলে
>> শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র না থাকলে সরকারি হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাক্ষর ও সিলসহ প্রত্যয়ন সনদ এবং জন্ম নিবন্ধন আবেদন ফরমের ৭ এর ১ নং কলামের স্বাক্ষর ও সিল বাধ্যতামূলক।
>> যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক
>> যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির আগে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক
>> যদি জন্ম ২০০১ সালের আগে হয় সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা মৃত হলে মৃত্যু সনদ বাধ্যতামূলক
>> যাদের জন্ম ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর তাদের পিতা-মাতা মৃত হলে প্রথমে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন গ্রহণ করার পর অনলাইন মৃত্যু নিবন্ধন সনদ গ্রহণ করতে হবে। উভয় সনদ আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
>> বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী ট্যাক্সের রশিদের হাল সন
>> আবেদনকারী/অভিভাবকের মোবাইল নম্বর
>> ফরমের সঙ্গে এক কপি রঙিন পাসপোর্ট সাইজের ছবি
> আবেদনের সঙ্গে কাগজপত্র সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য/নারী সদস্যদের স্বাক্ষরসহ সিল বাধ্যতামূলক।
সাহো