নিউজ ডেস্ক : রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও শুরুর দিকে জীবনটা ছিল খুব সাদামাটা। সেভাবেই পার্থিব যাত্রাও শেষ হতে চলেছে প্রিন্স ফিলিপের। আগামী ১৭ এপ্রিল তার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে থাকছেন শুধু পরিবারের ঘনিষ্ঠরা। ফিলিপের জন্ম হয়েছিল গ্রিক এবং ড্যানিশ রাজপুত্র হিসেবে। আয়োনিয়ান সমুদ্রে গ্রিক দ্বীপ কোর্ফুতে ফিলিপের জন্ম ১৯২১ সালের ১০ জুন। বাবা অ্যান্ড্রু ছিলেন গ্রিস ও ডেনমার্কের যুবরাজ। মা অ্যালিস ব্রিটেনের অভিজাত ব্যাটেনবার্গ বংশের মেয়ে। তাদের পঞ্চম সন্তান তথা একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন ফিলিপ।
জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন গ্রিস ও ডেনমার্কের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। কিন্তু সিংহাসনে বসার সৌভাগ্য তার হয়নি। ফিলিপের জন্মের পরেই পরিবারের উপর নেমে এল নির্বাসনের দণ্ড। কমলালেবুর বড় বাক্সে অস্থায়ী বিছানা বানিয়ে তাকে সেখানে শুইয়ে নিয়ে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে চেপে বসল রাজ পরিবার। পরবর্তীতে তার ৪ বোনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় হয়েছিলেন ফিলিপ। বোনদের মধ্যে ৩ জন মার্গারিটা, সেসিল এবং সোফির বিয়ে হয়েছিল জার্মান অভিজাতদের সঙ্গে। তাদের স্বামীরা ছিলেন হিটলারের নাৎসী দলের সদস্য। চতুর্থ বোনের নাম ছিল থিয়োডরা।
ফিলিপের বোন সোফি এবং তার স্বামী প্রিন্স ক্রিস্টোফ হেস হিটলারের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভোজসভায় যোগ দিতেন। তাদের প্রথম সন্তানের নামকরণও করেছিলেন ‘হিটলার’-এর নামে। ফিলিপের আর এক বোন সেসিলের জীবনের পরিণতি ছিল করুণ। ১৯৩৭ সালে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়। সে সময় সেসিলের গর্ভে ছিল তার চতুর্থ সন্তান। বিমান দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তে একটি মৃত সন্তান প্রসব করেছিলেন সেসিল। দুর্ঘটনার পরে তার পাশে উদ্ধার হয়েছিল সেই সদ্যোজাতর দেহও। এ ছাড়াও মৃত্যু হয়েছিল সেসিলের স্বামী এবং তাদের আরও দুই শিশুপুত্রের। তার অন্ত্যেষ্টি এবং শোকযাত্রায় আত্মীয় পরিজন সকলে নাৎসীদের পোশাক পরেছিলেন। সেসিলের মেয়ে জোহান্না দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেয়েছিল। কিন্তু দু’বছর পরে সেই শিশুও মারা যায় মেনিনজাইটিসে।
যুবরাজ ফিলিপ মায়ের দিক দিয়ে ব্রিটিশ রাজপরিবারের দূর সম্পর্কের বাঁধনে যুক্ত ছিলেন। তার মা অ্যালিস ছিলেন রানি ভিক্টোরিয়ার দৌহিত্রীর মেয়ে। রাজ পরিবারের রীতি অনুযায়ী ছাত্রজীবনে নামের পাশে কোনও পদবি ব্যবহার করতেন না তিনি। এ নিয়ে সহপাঠীদের কাছে ঠাট্টা ও বিদ্রূপের শিকারও হতেন তিনি। ফিলিপের মাতামহ ছিলেন ব্রিটেনের প্রিন্স লুইস অব ব্যাটেনবার্গ। পরে তিনি পরিচিত হন লুইস মাউন্টব্যাটেন নামে। এই ‘মাউন্টব্যাটেন’ পরিচয়ই গ্রহণ করেন ফিলিপ। যোগ দেন ব্রিটেনের রয়্যাল নেভি-তে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনে তীব্র জার্মানি-বিরোধী হাওয়ায় তিনি জার্মান উপাধি ও সংসর্গ ছিন্ন করতে বাধ্য হন।
১৯৪৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের বড় মেয়ে প্রিন্সেস এলিজাবেথকে বিয়ে করেন ফিলিপ। বিয়ের আগে নিজের জন্মগত গ্রিক ও ড্যানিশ রাজ উপাধি ত্যাগ করেন ফিলিপ। এর পর থেকে তিনি পরিচিত হন শুধু ব্রিটিশ পরিচয়ে। তার পরিবারের নাৎসী-যোগ নিয়ে যুবরাজ ফিলিপ দীর্ঘ দিন প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। ছ’দশকের নীরবতা তিনি ভাঙেন ২০০৬ সালে। বলেন, এটা ঠিক যে আরও অসংখ্য জার্মানের মতো তার পরিবারও প্রথমে হিটলারের মতবাদকে আকর্ষণীয় বলে মনে করেছিল। হিটলার যে জার্মানদের হৃত গৌরব ও ক্ষমতা উদ্ধারের জন্য বলেছিলেন, সেই লক্ষ্য তাদের ভাল লেগেছিল। এ কথা স্বীকার করেন ফিলিপ।
কিন্তু একইসঙ্গে যুবরাজ এ কথাও বলেন যে তার পরিবারের কোনও সদস্যের মধ্যে ইহুদি-বিদ্বেষ মনোভাব ছিল কি না, সে বিষয়ে তিনি জ্ঞাত নন। তবে তার নিজের নাৎসী-বিরোধিতা নিয়ে কোনও সংশয় কোনও দিন দেখা দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি ব্রিটেনের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে তার প্রেমপর্বে জার্মান বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছিল। তাদের বিয়েতে ফিলিপের ৩ বোনের মধ্যে কেউ আমন্ত্রিত ছিলেন না।
বোনদের থেকে দূরে তো বটেই, যুবরাজ ফিলিপ আজীবন তার মা অ্যালিসের সান্নিধ্যও পাননি। অ্যালিস ছিলেন জন্মগত ভাবে বধির। তবে তিনি কথা বলতে পারতেন। তার জীবনের বড় অংশ কেটেছিল মানসিক রোগের চিকিৎসাকেন্দ্রে। ১৯৩২ সালে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে মুক্তির পরে সন্ন্যাসিনীর জীবন গ্রহণ করেছিলেন তিনি।
গ্রিস ও ডেনমার্কের যুবরাজ অ্যান্ড্রুর প্রেমে পাগল ছিলেন অ্যালিস। তাদের বিয়ে হয় ১৯০৩ সালে। তবে তাদের বিবাহিত জীবন কোনও দিনই সুখকর ছিল না। তাদের মধ্যে শেষ অবধি বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও অ্যান্ড্রু তার প্রেমিকার সঙ্গে থাকতেন ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরায়। এই পারিবারিক পরিস্থিতিতে যুবরাজ ফিলিপের দিন কাটত বোর্ডিং স্কুলে এবং ছুটিতে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে।
নিজের জীবনের এই শূন্যতা সন্তানদের জীবনে ফিরে আসতে দেননি প্রিন্স ফিলিপ। রাজকর্মের পাশে তিনি সবসময় চেষ্টা করে গিয়েছেন একজন দায়িত্ববান বাবার ভূমিকা পালন করার। স্বামী হিসেবেও তার ভূমিকা খুব বেশি বার অনুবীক্ষণের নীচে আসেনি। তবে গুঞ্জন, আরও বহু রাজপুরুষের মতো তারও বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল।
১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানা এবং তার প্রেমিক দোদি আল ফায়েদের রহস্যমৃত্যুর পরে দোদির বাবা মিশরীয় শিল্পপতি মহম্মদ আলফায়েদ অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন প্রিন্স ফিলিপের দিকে। শিল্পপতির অভিযোগ ছিল, তার ছেলে এবং ডায়ানাকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে প্রিন্স ফিলিপের নির্দেশেই। তবে এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিপক্ষেও নানা তথ্য জানা যায়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ও রাজপরিবার বিশেষজ্ঞদের মতে, ফিলিপের সঙ্গে ডায়ানার স্নেহের সম্পর্ক ছিল। সেখানে কোনো কৃত্রিমতার ছাপ ছিল না। ডায়না-চার্লসের বিয়েটা যেন না ভাঙে সেই চেষ্টাও ফিলিপ করেছিলেন। চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরও ডায়ানার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন ফিলিপ।