নিজস্ব আক্রমণ পদ্ধতিতে ভিনদেশি এসব কামান পরিচালনা যুদ্ধক্ষেত্রেই শিখেছে ইউক্রেইন। স্থানীয়ভাবে তাদের তৈরি কিছু সফটওয়্যার সহজেই ট্যাবলেট কম্পিউটার ও স্মার্টফোনগুলোকে পরিণত করছে লক্ষ্যবস্তূতে নিশানা করার কার্যকর যন্ত্রে, যা ইউক্রেইনের সামরিকবাহিনীতে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
সবশেষ খবর হল ইউক্রেনকে ১৪টি লেপার্ড ট্যাংক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জার্মানি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ৩১টি আব্রামস ট্যাংক দেবে ইউক্রেনকে।
ইউক্রেইনের এই যুদ্ধক্ষেত্র কীভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলোর যুদ্ধাস্ত্র আর উদ্ভাবনী সমর কৌশলের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে সিএনএন এর এক প্রতিবেদনে।
সিএনএন জানিয়েছে, ইউক্রেইন একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছে, যা স্যাটেলাইট ছবি আর গোয়েন্দা তথ্য পেলে সঠিক সময়ে হামলার একটি ছক তৈরি করে দিতে পারে, যা ব্যবহার করে যুদ্ধে থাকা বাহিনীগুলো খুব কাছাকাছি থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ শানাতে পারে।
আর এটা যেহেতু অ্যাপ, খুব সহজেই এটা আপডেট কিংবা উন্নয়ন ঘটানো যায়। আবার একসঙ্গে অনেকে এটা ব্যবহার করতে পারেন।
যে মার্কিন কর্মকর্তারা ওই অ্যাপের বিষয়ে জানেন, তারা বলছেন, ইউক্রেইনের কামানগুলো দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে হামলা করার ক্ষেত্রে সেগুলো দারুণ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
সিএনএন লিখেছে, এরকম কয়েক ডজন কৌশল বা সরঞ্জাম ইউক্রেইন উদ্ভাবন করেছে, যেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যয়বহুল সমস্যার তুলনামূলক সস্তা সমাধানের পথ বাৎলে দিয়েছে তাদের। প্রায় এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইউক্রেইন এসব অ্যাপ উদ্ভাবন আর উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে।
মাথার উপর নিঃশব্দে উড়ে চলা ছোট্ট প্লাস্টিকের ড্রোন গ্রেনেড বা বিস্ফোরক ফেলে চলেছে রুশ সেনাদের উপর। সৈন্যরা যাতে যুদ্ধক্ষেত্রেই ভারী যন্ত্রপাতি মেরামত করে ফেলতে পারে, সেজন্য থ্রিডি প্রিন্টারে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে এখন।
ইউক্রেইনের টেকনিশিয়ানরা সাধারণ পিকআপ ট্রাকগুলোকে ভ্রাম্যমাণ মিসাইল লঞ্চারে রূপান্তরিত করেছেন। মিগ-২৯ এর মত পুরনো সোভিয়েত যুদ্ধবিমানগুলোর সঙ্গে অত্যাধুনিক মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে যুক্ত করা যায়, সেই কৌশল রপ্ত করে নিয়েছেন ইউক্রেইনের ইঞ্জিনিয়াররা। ফলে যুদ্ধ শুরুর এক বছর পরও ইউক্রেইনের বিমানবাহিনী তাদের আকাশে অক্ষত থেকে উড়তে পারছে।
এমনকি সোভিয়েত রকেটের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে ইউক্রেইন নেপচুন নামে জাহাজ বিধ্বংসী নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করেছে, যা প্রায় ২০০ মাইল দূর থেকে রুশ নৌবহরকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে সক্ষম।
ইউক্রেইনের এ ধরনের উদ্ভাবন মার্কিন কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়োজনে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে এমন উদ্ভাবনে কিইভের সক্ষমতার প্রশংসা করেছেন তারা, যেসব উদ্ধাবন পশ্চিমা সমৃদ্ধ অস্ত্রসরঞ্জাম ব্যবহারের কৌশলগত ঘাটতিকে অনেকটা পূরণ করছে এতদিন।
অবশ্য ইউক্রেনের নিজস্ব উদ্ভাবিত এসব কৌশল বা সরঞ্জাম ঠিক কীভাবে কাজ করছে, সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা মার্কিন বা অন্যান্য পশ্চিমা কর্মকর্তাদের নেই, কারণ তারা যুদ্ধের ময়দানে থেকে সেগুলো যাচাই করতে পারছেন না। তবে ইউক্রেইন যে সস্তা কিন্তু কার্যকর সমর কৌশলের একটি যথার্থ গবেষণাগার হয়ে উঠেছে, এ বিষয়ে তাদের সন্দেহ নেই।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের ডিরেক্টর সেথ জোন্স বলেন, “তাদের (ইউক্রেইন) এসব উদ্ভাবন অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয়।”
বাস্তব যুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা
যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদেরকে অস্ত্র সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা ভালোভাবে কাজ করতে পারে, তা দেখার একটি সুযোগ তাদের করে দিয়েছে ইউক্রেইন যুদ্ধ।
আর আধুনিক যুগের লড়াইয়ে জয় পেতে উভয় পক্ষ কী ধরনের অস্ত্র, সরঞ্জাম বা কৌশল ব্যবহার করছে, তাও দেখে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেইনের পাওয়ার গ্রিড ধ্বংস করতে রাশিয়া কীভাবে ইরানের তৈরি সস্তা ড্রোন দিয়ে সফলভাবে আক্রমণ চালিয়েছে, সেটাও এ যুদ্ধে দেখার সুযোগ হয়েছে মার্কিন অপারেশন অফিসার ও সামরিক কর্মকর্তাদের।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে সিএনএন লিখেছে, সবদিক বিবেচনা করে ইউক্রেন বাস্তব অর্থেই একটি অস্ত্রের গবেষণাগার হয়ে উঠেছে, কারণ এসব অস্ত্র ও সরঞ্জামের কোনোটিই এর আগে শিল্পোন্নত দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি কখনও। তাদের ভাষায়, এটা ‘বাস্তব যুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা’।
আর ইউক্রেনের যুদ্ধ মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য তাদের নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামের প্রয়োগিক সুবিধা অসুবিধার তথ্য পাওয়ার দারুণ এক উৎস।
মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা এবং এক ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থার বরাতে সিএনএন লিখেছে, ইউক্রেইনকে দেওয়া সুইচব্লেড ৩০০ ড্রোন এবং শত্রুর রেডার সিস্টেমে আক্রমণ চালাতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্রের মত ‘হাই-প্রোফাইল’ মার্কিন সমর সরঞ্জাম যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাশার তুলনায় কম কাজে দিয়েছে।
কিন্তু আমেরিকার তৈরি হালকা ওজনের এম১৪২ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার বা হাইমারস মিসাইল আবার ইউক্রেইনের সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এমনকি এ ধরনের অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতটা মেরামত প্রয়োজন হয়, আর রক্ষণাবেক্ষণ কতটা লাগে, সে বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, সীমিত পরিমাণে সরবরাহ করা হাইমারস মিসাইল দিয়ে ইউক্রেইন যেভাবে রুশ সেনা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, কমান্ড পোস্ট, হেডকোয়ার্টার আর সামরিক ডিপোতে আক্রমণ চালিয়েছে, তা ছিল অপ্রত্যাশিত। যুদ্ধক্ষেত্রের এসব তথ্য রীতিমত মার্কিন সমরবিদদের চোখ খুলে দিয়েছে, কারণ এসব জানতে তাদের বছরের পর বছর গবেষণা করতে হত।
এই ‘পরীক্ষাগার’ থেকে নিজেদের আরও একটি যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেটা হল তাদের এম৭৭৭ হাউইটজার। এসব হালকা কামান ইউক্রেইনের সমর শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এ অস্ত্রের একটি খুঁত এই যুদ্ধক্ষেত্রেই স্পষ্ট হয়েছে। আর তা হল, এ কামান দিয়ে অল্প সময়ে অনেক বেশি শেল নিক্ষেপ করা হলে এর নির্ভুল লক্ষ্যভেদের হার এবং কার্যকারিতা কমে যায়।
আর ইউক্রেইনীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন নতুন যে কৌশলগত উদ্ভাবন ঘটিয়ে চলেছে, তা পশ্চিমা কর্মকর্তাদেরও অবাক করে দিচ্ছে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে কিইভে রাশিয়ার হামলার সময় ইউক্রেইনের কমান্ডাররা তাদের পদাতিক বাহিনীকে ছোট ছোট সৈন্যদলে বিভক্ত করে পাল্টা হামলা চালিয়েছিলেন।
কাঁধে স্টিংগার ও জ্যাভেলিন রকেট লঞ্চার নিয়ে ইউক্রেইনীয় সেনারা তাদের দুই পাশে পদাতিক সৈন্যবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই অতর্কিতে রাশিয়ার ট্যাঙ্কগুলোর কাছাকাছি যেতে সক্ষম হয়েছে।
একুশ শতকের বিশ্বে আধুনিক দুটি দেশের মধ্যে কীভাবে যুদ্ধ হয় এবং তা কী ফল বয়ে আনতে পারে, তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্রও।
এক মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, এই যুদ্ধ এম৭৭৭ হাউইটজার সিস্টেমের মত আর্টিলারি বহর সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করতে পারে। এম৭৭৭ এর মত যেসব কামানকে টেনে নিয়ে যেতে হয়, আধুনিক যুদ্ধে সেগুলো ‘সেকেলে’ বলে মনে হতে পারে, কারণ এ কামান দিয়ে আক্রমণের সময় পাল্টা গোলা এড়াতে তড়িঘড়ি এগুলো সরিয়ে নেওয়া কঠিন। ড্রোন আর আকাশে নজরদারির যুগে এ কামান লুকিয়ে রাখাও কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে কানেটিকাটের প্রতিনিধি এবং হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির সদস্য জিম হিমস বলেন, “ইউক্রেইন যুদ্ধ থেকে কী শিখেছি যদি সেটা বলতে হয়, তাহলে আস্ত একটা বই লিখে ফেলতে হবে।”
কেবল যুদ্ধাস্ত্রের সক্ষমতা-দুর্বলতা জানা নয়, ইউক্রেইন যুদ্ধ মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের জন্যও নতুন ধারণা নেওয়ার এবং নতুন বাজার তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী ব্রিটিশ কোম্পানি বিএই সিস্টেমস ইতোমধ্যে জানিয়েছে, রাশিয়ার কামিকাজি ড্রোনগুলোর সাফল্য থেকে ধারণা নিয়ে নতুন একটি সাঁজোয়া যানের নকশা করেছে তারা, যেখানে উপর থেকে চালানো আক্রমণ থেকে সৈন্যদের রক্ষায় বাড়তি বর্ম যোগ করা হয়েছে।
এ এমন এক যুদ্ধ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং মার্কিন সমর শিল্পের অনেকে তাদের নতুন নতুন অস্ত্র ও সরঞ্জাম পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছে। আর মরিয়া ইউক্রেইন চেয়েছে, যা যা পাওয়া সম্ভব, তার সবই আদায় করে নিতে।
যুদ্ধের প্রথম দিকে ন্যাশনাল জিওস্পেশাল-ইনটেলিজেন্স এজেন্সি ইউরোপে ইউএস স্পেশাল অপারেশন কমান্ডের কাছে পাঁচটি হালকা ওজনের নজরদারি ড্রোন পাঠিয়েছিল। যদি সেগুলো ইউক্রেইনের কাজে আসে, সে ভাবনা থেকে পাঠানো হয়েছিল ড্রোনগুলো।
হেক্সাগন কোম্পানির তৈরি ওই ড্রোনগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের তথাকথিত ভবিষ্যত প্রতিরক্ষা কর্মসূচির অংশ ছিল না। এ থেকে বোঝা যায়, ইউক্রেইন যুদ্ধকে আসলে পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহারের কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের তখন থেকেই ছিল।
ন্যাশনাল জিওস্পেশাল-ইনটেলিজেন্স এজেন্সির সাবেক প্রধান, মার্কিন নেভির ভাইস অ্যাডমিরাল রবার্ট শার্প সে সময় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি ইউরোপীয় ‘সামরিক অংশীদারকে’ ওই ড্রোনের বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিয়েছে।
গত বসন্তে ডেনভারে একটি স্যাটেলাইট কনফারেন্সের ফাঁকে শার্প সিএনএনকে বলেন, “এটা (ওই নজরদারি ড্রোন) যে কাজে দেয়, সেটা হল, মেঘের নিচে লুকিয়ে থেকে আপনার চারপাশের এলাকার ভূস্থানিক তথ্য সে সংগ্রহের সুযোগ করে দেয়।”
সিএনএন লিখেছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের একটি অংশ বেশ ভালাভাবেই চেষ্টা করেছেন যাতে ওই ড্রোন ইউক্রেইন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
একাধিক গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, ইউক্রেইন যুদ্ধের অর্জিত জ্ঞান থেকে এখন একক ব্যবহারের সস্তা ড্রোনের মত অস্ত্র তৈরির দিকে আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠবে প্রতিরক্ষা ঠিকাদাররা।