সাগর হোসেন : করোনাভাইরাস মহামারীতে এ পর্যন্ত দেশে গড় মৃত্যুহার যেখানে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, সেখানে চট্টগ্রাম বিভাগের তিন জেলা এবং ঢাকা বিভাগের এক জেলায় এই হার ৪ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশের মানচিত্রে চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর এবং ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জের অবস্থান পাশাপাশি। এর মধ্যে ফেনীর সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার সীমান্ত রয়েছে।
ঢাকা ও চট্টগ্রামে কোভিডে মৃত্যুর মোট সংখ্যা দেশের অন্য সব জেলার চেয়ে অনেক বেশি হলেও শনাক্ত রোগীর তুলনায় মৃত্যু হার দেশের গড় হারের চেয়েও কম।
গতবছর মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় ৫ হাজার ১৮৭ জন কোভিড রোগী ধরা পড়েছে। সরকারি হিসাবে এই জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮৩ জনের।
অর্থাৎ, চাঁদপুর জেলায় মৃত্যু হার ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ, যা দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ।
পাশের জেলা কুমিল্লায় এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৯৮ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মারা গেছেন ৬৮৫ জন।
সেই হিসেবে কুমিল্লায় মৃত্যু হার ৫ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর মোট মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরেই কুমিল্লার অবস্থান।
কুমিল্লার পাশের জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৃত্যু হার ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর কুমিল্লা ও চাঁদপরের লাগোয়া ঢাকা বিভাগের জেলা মুন্সীগঞ্জে এই হার ৪ দশমিক ০৭।
দেশে আর কোনো জেলায় মৃত্যুহার ৪ শতাংশের বেশি নয়। তবে ওই চার জেলার আশপাশের এলাকগুলোতেও মৃত্যু হার তুলনামূলকভাবে বেশি। লক্ষ্মীপুরে ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ফেনীতে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, নারায়ণগঞ্জে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, নরসিংদীতে ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ।
ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা, বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী, খুলনা বিভাগের সীমান্ত জেলা চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরেও মৃত্যুহার তিন শতাংশের বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত দেশে শনাক্ত কোভিড রোগীর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৭৮ হাজার ৮০৪ জনে। তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৯৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে এ পর্যন্ত মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
রাজধানীসহ ঢাকায় জেলায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৯ হাজার ২৫৩ জন কোভিড রোগী। ৫ হাজার ৪৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এই জেলায়, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। শনাক্ত রোগীদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম জেলায় এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৯২৮ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৭৮৫ জনে। তাতে মৃত্যুহার হচ্ছে ১.৩৮ শতাংশ।
এই দুই মহানগরীর মাঝে কয়েকটি জেলায় মৃত্যুহার বেশ কেন, সেই প্রশ্নে জেলার শীর্ষ চিকিৎসকরা, শুরুর দিকে প্রস্তুতির অভাব এবং যোগাযোগের সুবিধার কারণে অন্য জেলার মানুষের বেশি আনাগোনার কথা বলেছেন।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ শুক্রবার রাতে এনবি নিউজকে বলেন, তার জেলার সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের যোগাযোগ বেশি। সে কারণে চাঁদপুরে ভাইরাস ছড়িয়েছে সহজে।
“ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চে সারাদিন হাজার হাজার মানুষ আসে, এটা মূল কারণ। পৌরসভায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে, উপজেলাগুলোতে কিন্তু তেমন না। অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বেশি থাকায় চাঁদপুর সব সময় উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। আর স্বাস্থ্যবিধি তো কোথাও মানে না।”
সিভিল সার্জন বলেন, “শুরুতে চিকিৎসা ব্যবস্থারও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, সে কারণে মৃত্যুর হার বেশি ছিল। এখন কমে এসেছে।”
কী ধরনের সীমাবদ্ধতা ছিল জানতে চাইলে সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, “আমাদের এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, হাইফ্লো নেইজল ক্যানুলা- কিছুই ছিল না। আবার মানুষজনও বাড়িতে চিকিৎসা নিত, হাসপাতালে আসতে চাইত না।”
করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় বলে অনেক রোগীকেই কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয়। সময়মত অক্সিজেন দিতে না পারলে তা রোগীর মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন ডা. মীর মোবারক হোসেন বললেন, সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক দিয়ে দেশের শীর্ষ জেলাগুলোর একটি কুমিল্লা।
“কুমিল্লায় মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথম দিকে আমাদের প্রস্তুতি কম ছিল, এ কারণে মৃত্যু বেশি হতে পারে। এছাড়া চিকিৎসার বিষয়ে মানুষের অবহেলাও ছিল শুরুতে। তবে গত এক মাস ধরে ডেথ রেট কমে গেছে। এখন আইসিইউ হয়েছে, চিকিৎসার সুযোগ বেড়েছে।”
তবে কুমিল্লায় সংক্রমণ বেশি হওয়ার পেছনে সীমান্তবর্তী ভৌগলিক অবস্থান বড় কোনো ভূমিকা রাখেনি বলেই মনে করছেন জেলার সিভিল সার্জন। তার দাবি, কুমিল্লার সীমান্ত ‘ভালোভাবেই সিল’ করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে পরামর্শ দিয়ে আসা ডা. মুশতাক হোসেন অবশ্য মৃত্যুহারে ওইটুকু কম-বেশিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না। তার ভাষায়, শনাক্তের হারে কমবেশি হচ্ছে ‘সঠিক তথ্যের অভাবে’।
এনবি নিউজকে তিনি বলেন, “সারাদেশে মৃত্যুর হার প্রায় কাছাকাছি। কমবেশি হচ্ছে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায়। শনাক্ত হয়েছে এক জায়গায়, মৃত্যুবরণ করেছে আরেক জায়গায়। আমাদের দেশের কোথাও এমন ঘনীভূত মহামারী হয়নি, যাতে একই এলাকায় অনেক মানুষ মারা যায়। যেটা ভারতের দিল্লি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে আমরা দেখেছি।”