কিন্তু কেন হঠাৎ করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়ছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে এই শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন মহামারীর প্রভাবের কথা।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহামারীতে লোকসানের ধাক্কায় অনেক খামার গেছে বন্ধ হয়ে। এখন মুরগির বাচ্চার দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, খাদ্য, ভ্যাকসিন ও ওষুধের দামও চড়া। ফলে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
এই কারণে চাহিদা ও জোগানের ফারাক বেড়ে যাওয়ায় ডিম-মুরগির বাজারে অস্থিরতা বলে জানাচ্ছেন তারা।
ডিমের দাম চোখ রাঙাচ্ছে পুষ্টিতে
হাতিরপুল বাজারে এক দোকানে বিক্রি হচ্চে ব্রয়লার মুরগি।
বাজারের চিত্র : ঢাকার খুচরা বাজারে এখন ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, লেয়ার ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা এবং সোনালী ৩৪০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে ডিমের ডজন ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে এই দাম রেকর্ড করেছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।
করোনাভাইরাসের লকডাউনের সময়ে খুচরা বাজারে ১০০ টাকার মধ্যে ব্রয়লার, ২০০ টাকার মধ্যে সোনালী এবং ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় লেয়ার মুরগি বিক্রি হয়েছিল। আর ডিমের ডজন তখন ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা।
পাইকারি বাজারে ব্রয়লার মুরগি ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা, সোনালী ৩২০ টাকা, লেয়ার ২২০ থেকে ২৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে বলে জানান ঢাকায় মুরগি ও ডিমের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কাপ্তান বাজারের শাহিনুর হেন্স হাউজের মালিক ওমর ফারুক।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে এপ্রিল থেকে আসে বিধি-নিষেধ। গত ২৩ জুলাই কঠোর লকডাউন দেয় সরকার। এরপর সংক্রমণ কিছুটা কমে আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধ তুলে ১১ অগাস্ট থেকে লকডাউন খুলে দেওয়া হয়।
এর আগে দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে গত বছরের মার্চের শেষ দিকে সারাদেশে লকডাউন দেয় সরকার। এরপর মধ্যে সংক্রমণ কমে গেলে বিধিনিষেধ কয়েক মাস শিথিল থাকে।
নিত্যপণ্য পরিবহনের গাড়ি লকডাউনের আওতামুক্ত থাকলেও পণ্য পরিবহনে তার প্রভাব ঠিকই পড়েছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
লকডাউনের সময় দাম কম থাকার কারণ সম্পর্কে খামারিরা বলছেন, ওই সময় ভোক্তাদের চাহিদা কমে গিয়েছিল, এজন্য লোকসান দিয়েই খামার খালি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা।
হিসাবে ফারাক : লকডাউনের সময় পোল্ট্রি খাতের উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল বলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) এক হিসেবে বলা হয়েছে; যদিও সরকারের হিসাবে তার উল্টো চিত্র দেখা যায়।
বিপিআইসিসির সভাপতি মশিউর রহমান এনবি নিউজকে বলেন, “করোনার সংক্রমণের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া পোল্ট্রি খামারগুলোর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাং উৎপাদনে ফিরেছে। এখনও ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বন্ধ হয়ে আছে। যে কারণে বর্তমানে উৎপাদন ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে।”
অন্যদিকে বাজারে চাহিদা বেড়ে গেলেও মুরগি ও ডিমের উৎপাদন কম থাকাকেই দাম বাড়ার কারণ দেখান তিনি।
বিপিআইসিসির এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা পোল্ট্রি সম্পৃক্ত, যার ৪০ শতাংশ নারী। ৬৫ হাজার খামারি এই খাতে যুক্ত আছেন।
২০২১ সালের মধ্যে এই খাতের বিনিয়োগ ৩৫ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং ১ কোটি মানুষ এতে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল বিপিআইসিসি।
ওই হিসাবে বলা হয়, দেশের চাহিদা দিনে প্রায় ৪ কোটি ডিম এবং সপ্তাহে দুই কোটি মুরগির বাচ্চা।
বছরে ১২ লাখ মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল বিপিআইসিসি। এছাড়া বছরে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ মেট্রিক টন পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়।
কিন্তু দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এসব হিসাব ‘এলোমেলো’ হয়ে গেছে বলে জানান বিপিআইসিসি সভাপতি মশিউর রহমান।
“আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা ও হিসাব ছিল মানুষের চাহিদাকে কেন্দ্র করে। সব কিছু যদি স্বাভাবিক থাকত, তাহলে এই টার্গেট হয়ত পূরণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু মহামারীর কারণে কোনো হিসাবই মেলানো বা পূরণ করা সম্ভব হয়নি।”
তবে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের হিসেবে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন স্বাভাবিক গতি দেখা যায়।অধিদপ্তরের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৭ কোটি ৫০ হাজার মুরগি উৎপাদন হয়েছে। পরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৯ কোটি ৬৬ লাখ, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ কোটি ৪১ লাখে।
এছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডিম উৎপাদন হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৭৩৬ কোটি। উৎপাদন বেড়ে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ২৬৬ কোটি ৪৪ লাখ ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ৫২৯ কোটি ৪ লাখ ডিম উৎপাদন হয়েছে বলে অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের হিসাবের সঙ্গে ফারাকের বিষয়ে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমানকে প্রশ্ন করলে তিনি ‘ব্যস্ত আছেন’ জানিয়ে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, “করোনাকালীন সময়ে বিপিআইসিসির হিসেবে ২৫ শতাংশ (খামার) বন্ধ ছিল বলে আমরা দেখেছি। কিন্তু করোনার সংক্রমণে সময় কিছু খাত লকডাউনের আওতামুক্ত ছিল, এর মধ্যে পোল্ট্রি খাতও আওতামুক্ত ছিল। যে কারণে উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়েনি।”
ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হচ্ছে, বলছেন খামারিরা : ১০ হাজার মুরগির নিয়ে গাইবান্ধার কদমতলা এলাকায় সোনালী পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি খামার গড়েছেন মো. জামাল। এই খামারে ডিম এবং বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।
এই খামারি বলেন, “করোনাকালীন সময়ে ডিমের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। সেই সময় পুঁজি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এক সময় খামারে মুরগি কমিয়ে ফেলতে হয়েছিল।”
পরে একটি ব্যাংক থেকে সরকারের প্রণোদনায় ২ শতাংশ সুদে ১৩ লাখ টাকার ঋণ নিয়ে ব্যবসা আবার দাঁড় করানোর চেষ্টায় রয়েছেন তিনি।
জামাল বলেন, পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খামারের ব্যয়ও বেড়ে গেছে। যে ফিডের বস্তা আগে ২ হাজার টাকা ছিল, এটি এখন ২৭০০ টাকা। এই দাম না কমলে মুরগির দামও কমার সুযোগ নেই।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার মেসার্স তুহিন পোল্ট্রির মালিক সাকিউল আলম তুহিন বলেন, মুরগির খাবার, বাচ্চা, ওষুধ-ভ্যাকসিনের দাম বেশি থাকায় পোল্ট্রির দরও বেশি।
বর্তমানে তার খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার ১৪০ থেকে ১৪২ টাকা বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ১৫০ টাকার উপরে উঠেছিল।
এই দামকে ‘ভালো’ বললেও ব্যয় বেশি থাকায় হিসাব করলে ‘পোষায় না’ বলে তুহিনের ভাষ্য।
লকডাউনের সময় লোকসানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারপরও হাল ছাড়িনি। লোকসান দিয়েই টিকে থাকতে হয়েছে। কারণ একবার যদি ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখান থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সহজ নয়।”সিরাজগঞ্জ সদরের মুজিব রোডের আপন পোল্ট্রির মালিক মো. ময়নাল মোল্লা বলেন, এখন দাম বাড়া নিয়ে কথা উঠলেও লকডাউনের সময় যে তাদের বড় লোকসান গুণতে হয়েছিল, সেকথা কেউ বলে না।
“গত বছর আমরা সোনালী মুরগি বিক্রি করেছি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। ব্রয়লারের দাম ছিল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। আমরা যারা সোনালী করেছি কেজিতে ১৯০ টাকা ব্যয় করে, ১৪০ টাকায় বিক্রি করে আমরা লোকসানের মধ্যে দিয়ে গেছি।”
ময়নাল বলেন, “যে কারণে বহু খামারি খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন আমরা যারা টিকে আছি, বাচ্চা হ্যাচিং করছি, কিন্তু পুঁজির অভাবে ছোট ছোট বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারিদের কাছে বাকিতে বাচ্চা দিতে পারছি না। এই কারণে তারা খামারগুলো চালু করতে পারছে না। এখনও ছোট ছোট অসংখ্য খামার বন্ধ।”
ময়নাল জানান, একদিন বয়সী একটি মুরগির বাচ্চা (৩৮-৪০ গ্রাম) এখন ৬৬ টাকা কিনতে হচ্ছে। আগে এর দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম না কমানো পর্যন্ত এই খাত স্বাভাবিক অবস্থায় যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রামের স্থানীয় কয়েক হাজার খামার থেকে মুরগি ও ডিম নিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত জেলার আনোয়ারা এলাকার ফিতান শাহ পোল্ট্রি।
এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারাধন দেবনাথ বলেন, “করোনার কারণে অধিকাংশ খামারই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় আমরা বড় ধরনের লোকসানে পড়ি। গত দেড়-দুই মাস ধরে আবার কিছু ফার্ম উৎপাদন শুরু করেছে। আমরা এখন নতুন বিনিয়োগ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছি।”
খামারিরা বলছেন, পোল্ট্রি ফিডের দাম কমানো, মুরগির বাচ্চার মূল্য হ্রাস, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা এবং করোনাভাইরাসের কবলে বন্ধ হয়ে যাওয়া খামার মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করা হলে এই খাত আগের অবস্থায় ফিরতে পারে।
ফিড বিক্রেতারা দেখাচ্ছেন আন্তর্জাতিক বাজার : ডিম-মুরগির পাইকারি বিক্রেতা কাপ্তান বাজারের শাহিনুর হেন্স হাউজের মালিক ওমর ফারুক মনে করেন, পোল্ট্রি ও ফিড উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত দেশের বড় কোম্পানিগুলোর ‘সিন্ডিকেটের’ কারণে মুরগির বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
তবে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারীরা এই অভিযোগ উড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারকে কারণ দেখাচ্ছেন।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিঅ্যাব) সভাপতি এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, গত চার মাসে ফিড তৈরির কাঁচামালের দাম গড়ে ৩৪ শতাংশ বেড়েছে।
“আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলে আমাদের দেশেও তা বেড়েছে। ফিড তৈরিতে ভুট্টায় ব্যবহার হয় ৫০ শতাংশ, এই ভুট্টার কেজি ১৯ টাকা থেকে ৩২ টাকা হয়েছিল। এখন ২৮ টাকার মতো্। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন কাঁচামালের দাম যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি শিপিং ব্যয়ও বেড়েছে।”
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশীয় ফিড প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর কিছু করার থাকে না দাবি করে তিনি বলেন, “তারপরও আমরা আমাদের ব্যবসার স্বার্থে, খামারিদের টিকে থাকার কথা বিবেচনা করে দাম যে পরিমাণ বাড়ার কথা ছিল, সেই পরিমাণ বাড়াইনি। এই কয়েক মাসে ফিডের দাম ৭ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে।”
এই পরিস্থিতি কবে নাগাদ সহনীয় হতে পারে, সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা না পাওয়ার কথা বলেন শাহজাহান।
“আমরা বিভিন্ন রিপোর্টে দেখছি, অ্যামেরিকান কিছু অঞ্চলে ফিড তৈরির ভুট্টা, সয়ামিলসহ অন্যান্য ফসলের বেশ ভালো ফলন হয়েছে। এই ফসল উঠার পর আমাদের দেশে এসলি খুলে আনতে অন্তত আরও তিন মাস সময় লাগতে পারে। আবার কিছু রিপোর্টে দেখছি দাম কমার আপাতত সুযোগ নেই।”