আজিজুর রহমান জিদনী : ঈদ মানেই ঢাকা থেকে বাড়ির পথে মানুষের ঢল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তো বটেই, সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরোধ ছিল— চিরচেনা সেই দৃশ্য যেন দেখতে না হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও অনুরোধ করেছেন, যে যেখানেই আছেন সেখানেই যেন ঈদ পালন করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী, সরকার কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এমন আহ্বান-অনুরোধে সাড়া মেলেনি। ঈদ এগিয়ে আসতে আসতে সরকার সীমিত পরিসরে গণপরিবহন চালু করলে সড়ক-মহাসড়কে বেড়েছে যানবাহনের চাপ। ফেরি ঘাটগুলোতেও নেমেছে মানুষের ঢল।
পুলিশ বলছে, গত বছরও করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়ই ঈদুল ফিতর পালন করা হয়েছে। সেবার ঈদের আগে রাজধানী থেকে অন্য জেলাগুলোতে মানুষের ঢল ঠেকাতে পুলিশকে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় তারা কঠোর ছিল। তবে এবার তেমন সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকায় এখনো খুব বেশি কঠোর হতে দেখা যায়নি পুলিশকে। বরং বেশিরভাগ জায়গাতেই তারা নিরুপায় ছিলেন বলেই জানাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে মাঠে নেমছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
দেশে চলতি বছরের মার্চে এসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ফের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ ও ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে। কঠোর বিধিনিষেধের আওতাতেই ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। এর মধ্যে বিধিনিষেধ চালু থাকলেও পরিবহন শ্রমিকসহ বিভিন্ন মহলের অনুরোধ ও বাস্তবতা বিবেচনায় ৬ মে থেকে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। তবে এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়, গণপরিবহন কেবল জেলার মধ্যে চলতে পারবে। কোনোভাবেই অন্য জেলায় যেতে পারবে না। অর্থাৎ দূরপাল্লার যানচলাচল বন্ধই থাকবে।
এদিকে, শুক্রবার ও গতকাল শনিবার শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে বিপুল পরিমাণ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। এ পরিস্থিতিতে ফেরিতে জনচলাচল ঠেকাতে শুক্রবার (৭ মে) রাত পৌনে ১২টার দিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) দিনে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। বলা হয়, রাতে কেবল অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার করবে ফেরিতে। পরে মানবিক কারনে গতকাল রাতে তাদের ফেরিতে পার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কসহ ফেরি ঘাটে গণপরিবহন ও মানুষের তীব্র চাপ থাকলেও পুলিশকে খুব বেশি কঠোর ভূমিকায় দেখা যায়নি কোথাও। পুলিশের দাবি, এবারের ঈদযাত্রায় মানুষের ঢল ঠেকাতে পুলিশের ওপর কোনো নির্দেশনা আসেনি। এমনকি পুলিশ সদর দফতর থেকেও বিশেষ কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি। তাই পুলিশ এবার নিরুপায় হয়ে পড়েছে। সে কারণেই এমনকি পুলিশের সামনে বাস, মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স ভরে লোকজন গ্রামের পথে ছুটলেও কিছু বলছে না পুলিশ সদস্যরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। পুলিশ তাই দূরপাল্লার কোনো গাড়ি চলাচল করতে দিচ্ছে না। আবার কিছুদিন আগে গণপরিবহন একদম বন্ধ ছিল। তখন কেউ রাজধানীতে গাড়ি চালাতে পারেনি। এমনকি জেলাগুলোতেও কেউ বাস চালাতে পারেনি। সরকার এখন শিথিল করায় গাড়ি চলছে।
এআইজি সোহেল রানা আরও বলেন, সরকার ফেরি চলাচল বন্ধ করেছে,। দূরপাল্লার বাস বন্ধ রয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ রেখেছে। সুতরাং পুলিশ মানুষদের আটকাবে— এরকম কোনো নির্দেশনা সরকার পুলিশকে দেওয়া হয়নি। তাই কেউ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটলেও পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে।
পুলিশের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে ও কঠোরভাবে বিধিনিষেধ পালন করতে বললে পুলিশ সর্বাত্মকভাবে মাঠে কাজ করে। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের সঙ্গে জনগণের বাক-বিতণ্ডা হয়। পরে দেখা যায় বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। ধীরে ধীরে মার্কেট ও শপিং মলও খুলে যায়। দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকলেও সব ধরনের গণপরিবহন চালু করা হয়। সব খুলে দিয়ে সাধারণ মানুষকে আটকানো কি সহজ কাজ?
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ঘরের মধ্যে বন্দি ছিল। হঠাৎ সবকিছু খোলা পেয়ে ছুটে বেরিয়েছে। এখন এত এত মানুষকে আটকানোর সক্ষমতা কি পুলিশের আছে? গণপরিবহন ও মার্কেট বন্ধ ছিল যখন, তখন কি এত মানুষ রাস্তায় বা ঘরের বাইরে ছিল?
পুলিশের ওয়ারী জোনের একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, সব ধরনের যানবাহন চলছে। মানুষ ছুটছে গ্রামের বাড়িতে। কাকে কে আটকাবে? পুলিশ কেন নির্দেশনা ছাড়া মানুষকে আটকাতে যাবে? সরকার নির্দেশ দিলেই কেবল পুলিশ মানুষকে আটকাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। এমনিতেই পুলিশের দোষ বেশি। সবাই ভিডিও করে আর ছেড়ে দেয়। পুলিশকে বিতর্কিত করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশ এখন অনেকাটিই নিরুপায়। দেখা যাক জনগণ কতদূর যেতে পারে। করোনার ভয় আমার-আপনার আছে, তাদের কেন নেই? এই যে ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের পথে ছুটছে, তাদের মধ্যে ভয়টাও তো আসতে হবে।
গণপরিবহন ও জনচলাচলের এ পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত মাঠে নামানো হয়েছে বিজিবি। সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জেলা প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ঈদে ঘরমুখী মানুষের ঢল ঠেকাতে শিমুলিয়া, বাংলাবাজর, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে আগামীকাল (রোববার) সকাল ৭টা থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজিবি মোতায়েন থাকবে।
এদিকে, সরকার যখন জনচলাচল ও গণপরিবহন চলাচলের পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম, তখন দূরপাল্লার গণপরিবহন চালু করতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছেন মালিক শ্রমিক পরিষদ নেতারা। শনিবার এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তারা জানিয়েছেন, গণপরিবহন চালু করতে না দিলে ঈদের দিন থেকে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করবেন।