২০১৯ সালে প্রথম আলো ঈদসংখ্যার জন্য আমি কবরীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তখন তিনি বেশ অসুস্থ। তারপরও নানা প্রশ্নের স্পষ্ট ও খোলামেলা উত্তরগুলো আমাকে বিস্মিত করেছিল।
আমরা জানি, কবরীর ৭১ বছরের জীবনে প্রায় ৫৮ বছর কেটেছে সিনেমাজগতে। সুভাষ দত্তের পরিচালনায় প্রথম সিনেমা সুতরাং-এ নায়ক সুভাষেরই বিপরীতে যখন অভিনয়জীবন শুরু করেন, তখন তিনি মাত্র ১৩ বছরের এক কিশোরী। সেই সিনেমার পর মিনা পাল থেকে কবরী নাম নেওয়া এই অভিনেত্রীর বিজয়ের যাত্রা শুরু। এই যাত্রাপথে তিনি অনেক স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছেন, সফলতা এসেছে। নাটক-সিনেমায় অভিনয়, পরিচালনা, প্রযোজনা করতে গিয়ে শুধু সিনেমার নায়ক, গায়ক, পরিচালক, অভিনেতাই নয়; এর বাইরেও বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। এত কিছুর পরও ওই সাক্ষাৎকারে তিনি দুঃখ করে আমাকে বলেছিলেন, জীবনে একজন ভালো বন্ধু বা ভালো স্বামী তিনি পাননি। সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন ভালো মানুষ পাননি, যাঁকে এ জীবনে বলতে পারেন, এসো, এক কাপ চা খাই, একটু গল্প করি।
আমার কাছে যখন তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন, তখন তাঁর জীবনের কথা ভাবছিলাম। এত বিচিত্র-বিস্তৃত জগতের মানুষটি শেষবেলা একদম একা। কত মানুষ ঘিরে রাখতেন তাঁকে চারপাশ থেকে! চলচ্চিত্রে অভিনয়, পরিচালনা ও প্রযোজনা ছাড়াও বহু ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, রাজনীতি করেছেন। কবরী ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। সদাহাস্য এই মানুষটির সঙ্গে যাঁদেরই যখন দেখা হতো, তাঁদের মুখও হাসি-আনন্দে ভরে যেত। অফিস বা অফিসের বাইরে আমাদের সঙ্গে তিনি যতটুকু সময় কাটাতেন, গল্পগুজব করতেন, চা খেতেন, পুরো সময়টুকুই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভরে থাকত। আসলেই আমি খুব কষ্ট পেয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনার ক্ষেত্রে কেন এমন হলো? তাঁর উত্তর ছিল, এটাই হয়তো মানুষের জীবন। মানুষের চাওয়ার তো শেষ নেই। তিনি মনে করেন, এটাও হতে পারে যে কেউ তাঁকে চাইলেও তিনি বুঝতে পারেননি। চিনতে পারেননি সেই মানুষটিকে। প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে এমনটি হয়।
কবরীর জীবনের একটা বড় আফসোস, যদি একজন বন্ধু থাকত, সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন মানুষ থাকত! সে আনন্দটুকু তিনি কোনো দিন পাননি।
সেই সাক্ষাৎকারে কবরী আমাকে আরও বলেন, সুতরাং সিনেমায় অভিনয়ের সময় তাঁর আপত্তি সত্ত্বেও পারিবারিক, আর্থিক ও অন্য নানা কারণে বিয়ে করতে হয়েছিল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেক কিছু হয়ে গেছে। সুতরাং-এর পর একের পর এক সিনেমায় সফল হতে থাকেন। সে সময় রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর জুটি সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র জুটি হিসেবে পরিচিতি পায়। এ ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে অভিনয় করলেও একদম নতুন মুখ আলমগীর, ফারুক, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও সোহেল রানার প্রথম নায়িকা ছিলেন কবরী। সারেং বৌ, তিতাস একটি নদীর নাম, ময়নামতি, সুজন-সখীসহ সফল সব সিনেমায় কাজের মধ্য দিয়ে অভিনয়শিল্পীর স্বীকৃতি তিনি আগেই পেয়েছিলেন।
দুঃখ-বেদনা সম্পর্কে কবরী আমাকে আরও বলেছিলেন, চলচ্চিত্র-জীবনে তিনি অনেক আনন্দ পেয়েছেন, জীবনকে উপভোগ করেছেন। আনন্দ পেয়েছেন বলেই তো এত দিন কাজ করলেন। তা ছাড়া আনন্দ না পেলে কষ্ট বুঝবেন কীভাবে?