১
বাংলাদেশের প্রথম স্থানীয়ভাবে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। সিনেমাটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সুপরিচিত হয়ে আছে সফলতার এক মাইলফলক হিসেবে।
মুখ ও মুখোশের প্রথম মহরত হয় হোটেল শাহবাগে, ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্টে। তবে বাংলাদেশে নির্মিত সিনেমা হলেও এর প্রথম প্রদর্শনী হয় পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে। ঢাকায় ফিরে আসার পর প্রযোজক সংস্থা ছবিটি প্রদর্শনীর বিষয়ে বিভিন্ন হল মালিকের দ্বারস্থ হলেও, কেউ তাতে গ্রিন সিগন্যাল দেয়নি। তবে এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। তখন ‘পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্ট’ ও ‘পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিস’ ছবিটি পরিবেশনার দায়িত্ব নেয়। প্রিমিয়ার শো রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হলেও, ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে জনসাধারণের জন্য প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রটির প্রথম প্রদর্শনী হয় মুকুল টকিজে, যা বর্তমানে আজাদ সিনেমা হল নামে পরিচিত। পুরান ঢাকার জনসন রোডে নির্মিত এই সিনেমা হল ছিল ঢাকায় নির্মিত প্রথম দশ সিনেমা হলের একটি। এই হলটিই একসময় ছিল ঢাকার অভিজাত পরিবারের সদস্যদের বিনোদনের প্রধান মিলনস্থল। এছাড়াও ১৯৩১ সালে ঢাকায় নির্মিত প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’ এই প্রেক্ষাগৃহেই মুক্তি পায়। ওই সিনেমা দিয়েই হলটির পথচলা শুরু।
মুকুল টকিজ ছাড়াও সিনেমাটি একযোগে মুক্তি পায় ঢাকার রূপমহল, চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড এবং খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে। শুরু থেকেই দেশের দর্শকমহলে থাকে সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ। কারণ, নিজ দেশের তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র, উচ্চাশা ও প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে থাকারই কথা। ফিল্মটি নিয়ে চরম উৎসাহের আরেকটি কারণ হলো, সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে নিজস্ব কোনো চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠেনি। স্থানীয় যে সিনেমা হলগুলো ছিল, সেগুলোতে হিন্দি, উর্দু এবং কলকাতার বাংলা সিনেমা প্রদর্শিত হতো।
২
মুখ ও মুখোশ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। পেছনে থেকে সমস্ত নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের রূপকার আব্দুল জব্বার খান। তবে, তিনি এই সিনেমা নির্মাণের কাজে হাত লাগান ১৯৫৩ সালে। তার এই চলচ্চিত্র নির্মাণের কাহিনীটাও বেশ মজার। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসানি পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে এক নেতিবাচক মন্তব্য করে বসেন। সেই নেতিবাচক মন্তব্য দারুণভাবে আঘাত করে জব্বার খানের মনে। তারপর ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে ড. সাদেক একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা। সভায় গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক বাহাদুর ফজল আহমেদ বলে ফেললেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্দ্র আবহাওয়া চলচ্চিত্র নির্মাণের উপযুক্ত নয়। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন অবাঙালি। এ কথার শোনার সাথে সাথে কঠোর প্রতিবাদ করে বসলেন আবদুল জব্বার খান। তিনি বললেন, এখানের মাটিতেই তো ভারতীয় সিনেমার বহু শুটিং হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমা তৈরিতে সমস্যা কোথায়? বাহাদুর ফজল আহমেদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন তিনি। বললেন, যেকোনো মূল্যেই হোক, চলচ্চিত্র বানিয়েই দেখাবেন।
একপ্রকার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েই এই চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হন তিনি। দীর্ঘ দুই বছর যাবত জব্বার খানের নিজ হাতের অতি-যত্নের ফসল এই সিনেমা। পুড়িয়েছেন বহু কাঠখড়। কলকাতা থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আনা মরিচা ধরা একটি আইসো ক্যামেরা ও অতি সাধারণ মানের একটি ফিলিপস টেপ রেকর্ডার দিয়ে ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। টেপরেকর্ডারটি ব্যবহার করা হয়েছিল শব্দ গ্রহণের কাজে। ওইসময় ধারেকাছে কোনো ফিল্ম প্রোডাকশন স্টুডিও ছিল না। তাই ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য ছবিটি সুদূর লাহোরে পাঠানো হয়। লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মুদ্রণ, পরিস্ফুটন ও সম্পাদনার কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৫৬ সালে ছবির কাজ পুরোপুরি সমাপ্ত হলেও, জব্বার খানকে ছবিটি নিয়ে ঢাকায় ফিরতে দেওয়া হয়নি। সম্পাদিত চলচ্চিত্র পূর্ব পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবদুস সাত্তার (বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট) এর সহায়তা গ্রহণ করতে হয়েছিল। বিমানে ফিল্ম এবং স্বর্ণ পরিবহন করা যাবে না– এই অজুহাতে বিমান থেকে ফিল্ম নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে ছায়াছবি পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
৩
তখন চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো স্টুডিও বা সুযোগ-সুবিধা ঢাকায় বিদ্যমান ছিল না। ছবিটির অর্থায়ন ও চিত্রায়নে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে ইকবাল ফিল্মস্। এই ইকবাল ফিল্মস গঠিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালের দিকে, বলতে গেলে আব্দুল জব্বার খানের একক প্রচেষ্টায়।
এর চেয়ারম্যান ছিলেন বলাকা সিনেমা হলের মালিক এম. এ. হাসান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুল জব্বার খানের সহকর্মী নুরুজ্জামান।
সেই ধারা অনুসরণ করেই পরবর্তীতে গড়ে উঠে কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেড। আব্দুল জব্বার খান ছাড়াও ইকবাল ফিল্মসের অন্যান্যরা হলেন শহীদুল আলম, মোহাম্মদ মোদাব্বের, মহিউদ্দিন। আর কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্স লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ড. আবদুস সাদেক, দলিল আহমদ, আজিজুল হক, দুদু মিয়া, কবি জসীম উদ্দিন, কাজী খালেক, সারওয়ার হোসেন প্রমুখ। বলে নেওয়া ভালো, দলিল আহমেদের পুত্র বুলবুল আহমেদ এবং দুদু মিয়ার পুত্র আলমগীর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দর্শক জনপ্রিয়তায় নিজেদেরকে অমলিন করে রেখেছেন।
৪
সিনেমার শুটিং শুরু হয় ১৯৫৩ সালের একেবারে শেষ দিকে, অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে। শুটিংয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গা বেছে নেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সিদ্ধেশ্বরী, কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারের পুকুরপাড়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, বুড়িগঙ্গার ওপারে কালীগঞ্জ, তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, জিঞ্জিরা, রাজারবাগ ও লালমাটিয়ার ধান ক্ষেত এবং টঙ্গীর বিভিন্ন জায়গা। ১৯৫৫ সালে শেষ হয় সমস্ত দৃশ্য ধারণ। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন অক্টোবরের ৩০ তারিখ।
৫.
অধিকাংশ জায়গা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, সর্বসাকুল্যে ছবিটির নির্মাণ ব্যয় ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী মুদ্রায় ৬৪ হাজার রুপি। আবার আবার কোনো কোনো জায়গায় বলা আছে এর নির্মাণ ব্যয় ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি রুপিতে ৮২ হাজার। এর মধ্যে ৪২ হাজার রুপি ঢেলেছিলেন অভিনয় শিল্পী আলমগীরের বাবা কলিম উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া। বাকি ৪০ হাজার দিয়েছেন তার চার বন্ধু। মুক্তির পর সিনেমাটি প্রথম দফায় নিজ ঝুলিতে পুরে নেয় প্রায় ৪৮ হাজার রুপির মতো।
৫
আব্দুল জব্বার খান অন্য কারও কাছে ধর্না না দিয়ে নিজের লেখা ‘ডাকাত’ গল্পকে উপজীব্য করে গড়ে তোলেন ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। বলে রাখা ভালো ফরিদপুরে সংঘটিত একটি ডাকাতির কাহিনীকে কেন্দ্র করে ‘ডাকাত’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন তিনি।
প্রথমে ছবির নাম রাখা হয়েছিল ‘ডাকাত’। পরে ফজল শাহাবুদ্দিনের পরামর্শে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘মুখ ও মুখোশ’। তবে চিত্রনাট্য নির্মাণে নিজ নাটক ‘ডাকাত’ এর পাশাপাশি আব্দুল জব্বার খান পল্লীকবি জসীম উদ্দিন ও কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বইকেও বেছে নেন। ডাকাত নাটকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। সেসময় তার সাথে ছিলেন কিউ এম জামান, যিনি প্রথমদিকে সিনেমাটির চিত্রগ্রহণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
চিত্রনাট্যকার হিসেবে কলকাতার মণি বোসের তখন প্রচুর নাম-ডাক। তাই মণি বোসকে তারা অনুরোধ করেন, তিনি যাতে এই পাণ্ডুলিপি ও বইগুলো থেকে চিত্রনাট্য রূপান্তর করে দেন। মণি বোস সবকিছু ঘেঁটে-ঘুঁটে তার ‘ডাকাত’ নাটকের পাণ্ডুলিপিকেই চিত্রনাট্য হিসেবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন। শুরুতে তিনি তিনটা দৃশ্য লিখে ফেলেন আর বাকিটা লাইন আপ করে জব্বার খানের উপর ন্যস্ত করে দেন। চিত্রনাট্যের নির্মাণের বাকি কাজটায় আবদুল জব্বার খান সহজেই উতরে যান। ডঃ সাদেকের বন্ধু সারওয়ার সাহেবের অনুপ্রেরণা আব্দুল জব্বার খানের জন্য ধনাত্মক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। নাটক ‘ডাকাত’-এর রিহার্সাল চলাকালীন সময়ে তিনি পুরো দলকে প্রচুর উৎসাহ, উদ্দীপনা প্রদান করেছিলেন।
৬
তখনের যুগে চলচ্চিত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ না হওয়া এবং নানা প্রতিবন্ধকতার দরুন নারী অভিনয়শিল্পী খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। পরিচালক চেয়েছিলেন, কোনো এক পুরুষ শিল্পীকে ধরে নারী সাজিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা থেকে পরে সরে যেতে হয়। তাই নারী শিল্পী খোঁজার জন্য বেছে নেওয়া হয় পত্রিকার বিজ্ঞাপন। চিত্রালী ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জহরত আরা ও ইডেন কলেজের ছাত্রী পিয়ারী বেগম নবাব কাটরায় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইকবাল ফিল্মসের অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করলেন।
পুরান ঢাকার মেয়ে জহরত আরার পরিবার অবশ্য আগে থেকেই এসবের সাথে যুক্ত ছিলেন। জহরতের ভাই মোসলেহউদ্দীন ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক, ভাবি নাহিদ নিয়াজীও ছিলেন সংগীত শিল্পী। বেতারে নাটকের অভিজ্ঞতা ছিল তার আগে থেকেই।
ওপার বাংলা (কলকাতা) থেকে এগিয়ে এসেছিলেন শিল্পী পূর্ণিমা সেন গুপ্ত। তিনিই হলেন নায়িকা কুলসুমের চরিত্র। পিয়ারী নাম নিলেন নাজমা, অভিনয় করলেন নায়ক আফজালের বোন রাশিদার চরিত্রে। ডাকাত সরদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ইনাম আহমেদ। স্থানীয় অভিনেতারা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিনা পারিশ্রমিকে এই ছবিতে অভিনয় করেন। জহরত আরার অভিনয় দর্শকমহলে ভূয়সী প্রশংসায় ভাসতে থাকতে। তবে পরে তাকে আর কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়নি। পরিচালক প্রথমে মূল নায়ক চরিত্র আফজাল চরিত্রে কলিম শরাফীকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু নায়ক চরিত্রের জন্য পারিশ্রমিক চেয়ে বসেন শরাফী ও তার বন্ধুরা। তাই, এক প্রকার বাধ্য হয়েই কলিম শরাফীকে কাস্ট করার চিন্তা বাদ দিতে হয়।
মজার ব্যাপার হলো পরিচালক নিজেই নায়ক আফজালের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অসৎ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে ছিলেন অভিনেতা আলী মনসুর। আর তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। দর্শকনন্দিত এই ছবিটি গভীরভাবে হৃদয়ে দাগ কাটে তরুণ সমাজের।
৭
অঙ্গসজ্জার দিকটা দেখেছেন শমসের আলী ওরফে শ্যাম বাবু। সুরঘর সামলেছেন সমর দাস। তারই পরিচালনায় সিনেমায় সুরের গলা মিলিয়েছেন আবদুল আলীম এবং মাহবুবা হাসনাত। সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন ধীর আলী। মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রে গানের সংখ্যা মোট দুটি। আবদুল জব্বার খানের কাছের বন্ধু গীতিকার গফুর সাহেব তাকে কথা দেন, তিনি বিনা পারিশ্রমিকে চারটি গান লিখে দিবেন।
কিন্তু কাহিনী ও চিত্রনাট্য সাজানোর পর দেখা গেলো দুটি গানেই প্রয়োজন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিনেমার উপর সম্পাদনার কাট-ছাট চালিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের আব্দুল লতিফ। ছবির মূল পোস্টার ডিজাইন করেন সুভাষ দত্ত। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন গওহর জামিল। শব্দ গ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন মইনুল ইসলাম। সেসময় পূর্ব-পাকিস্তানে কোনো রেকর্ডিং স্টুডিও বা গ্রামোফোন কোম্পানি গড়ে না উঠায়, গান রেকর্ডের কাজ শেষ করা হয় টেপে। ‘ইকবাল ফিল্মস’ এর অফিস রুমের চারদিকে কাপড় টাঙ্গিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কৃত্রিম স্টুডিও।
৮
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা সিনেমার মহরতের উদ্বোধন করেন। মহরতে বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন জহরত আরা। শোনা যায়, মহরত অনুষ্ঠানের আগে বিপুল বর্ষণে শাহবাগ এলাকায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে গিয়েছিল। গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা এর মধ্যেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ছবির প্রথম প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি ছিলেন শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক।
৯
নিজের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের আগেই আবদুল জব্বার খানকে এর কারিগরি অংশগুলোর দিকে একটু আলোকপাত করতে হয়েছিল। শুরুতে তিনি ক্যামেরাম্যান হিসেবে সারোয়ার সাহেবকে নির্বাচিত করেন। কারণ, তিনি তখন সারোয়ার সাহেবের মালিকানাধীন একটি ৩৫ মি.মি. ক্যামেরা দিয়ে সিনেমা শুট করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। পরবর্তীতে কিউ. এম. জামানের মতামতের কারণে সারোয়ার সাহেবকে সে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেছিলেন, “সারোয়ার সাহেবের এই সাধারণ ক্যামেরায় সিনেমা নির্মাণ সম্ভব না”।
কিউ. এম. জামান কলকাতা এবং বোম্বেতে চিত্রগ্রাহকের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করার দরুন আব্দুল জব্বার খান তার উপর পূর্ণ ভরসা স্থাপন করেছিলেন। জামানের এই মন্তব্যের পরেই পুরো দল ক্যামেরা কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। আগেই বলা হয়েছে, মণি বোসের কাছ থেকে চিত্রনাট্য তৈরিতে সাহায্য নেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা গিয়েছিলেন আব্দুল জব্বার খান। সেসময় নিউ থিয়েটার্সের প্রধান চিত্রগ্রাহক মুরারি মোহন ঘোষের সহযোগিতায় একটি পুরাতন আইমো ক্যামেরা কিনে ফেলেন তারা। কিউ এম জামান কলকাতায় এই মুরারি মোহনেরই দ্বিতীয় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তখন তারা মুরারি মোহনের সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। পাঁচ হাজার ভারতীয় রুপীর বিনিময়ে তিনি মুখ ও মুখোশের চিত্রগ্রহণের কাজ করবেন।
১০
শুরুর দিকে সিনেমার চিত্রগ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন চিত্রগ্রাহক মুরারি মোহন ঘোষ। তবে কিছুদিন চিত্রগ্রহণ করার পর ডাকাত দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মোহাম্মদ হোসেন (বিচারপতি) শুটিংয়ে আসা বন্ধ করে দেন। ফলে, চিত্রনাট্যে পরিবর্তন ঘটানোর পাশাপাশি, চিত্রগ্রহণের কাজও কিছুদিন বন্ধ রাখতে হয়। তবে সমস্যা এখানেই থেমে ছিল না। এরপরেই দেশে আঘাত হানে ‘৫৪ সালের বিধ্বংসী বন্যা, ফলে চিত্রগ্রহণের কাজে ভাটা পড়ে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য। সময়টা কাজে লাগালেন পরিচালক। ক্যামেরায় শুট করা ফুটেজ লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন। সেখানে প্রিন্ট করার পর ফুটেজের নানা ত্রুটি ধরিয়ে দেন স্টুডিওর লোকেরা। সাথে স্টুডিওর মালিক ও টেকনিশিয়ানরা এ পরামর্শও দেন, কীভাবে চিত্রগ্রহণ করলে তা ত্রুটিমুক্ত থাকবে। সেখান থেকে সব ভালো করে শিখে এসে দেশে ফিরলেন আব্দুল জব্বার খান। কিন্তু নতুন করে আরেকটি সমস্যা পাকালো। দলে অনুপস্থিত থাকলেন কলকাতার চিত্রগ্রাহক মুরারি মোহন। জানা গেলো, তিনি আর তাদের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন না। তখন পরিচালক জব্বার খান কিউ. এম. জামানকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন– চলচ্চিত্রের বাকি চিত্রগ্রহণ তিনি সম্পাদনা করতে পারবেন কিনা। কিউ. এম. জামানের প্রত্যয়দীপ্ত উত্তর পুরো দলে নতুন জোয়ারের সঞ্চার ঘটায়। আবারও স্বতঃস্ফূর্ত মহরতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ‘৫৫ সালে শুটিং শেষ হওয়ার আগে আরও একবার বন্যার কবলে পড়তে হয়েছিল মুখ ও মুখোশের টিমকে। বন্যার পর বাকি কাজ শেষ করা হয়।
শাহনূর স্টুডিওতে তিন মাস অবস্থান করে অভিজ্ঞ সম্পাদক লতিফ সাহেবের তত্ত্বাবধানে ছবির সম্পাদনা শেষ করা হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রের শব্দের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। সম্পাদক পরামর্শ দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পীদের দিয়ে ডাবিং করিয়ে নিতে। কিন্তু আব্দুল জব্বার খান সে চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পীরা ভালো করে বাংলা বলতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে সম্পাদক প্রচুর সময় নিয়ে শব্দের প্রত্যেকটা অক্ষর ফ্রেম কেটে জোড়া লাগিয়ে বহু কষ্টের সম্পাদনা কাজের সমাপ্তি ঘটান।
মুখ ও মুখোশের নির্মাণ কথা যেন আপাদমস্তক এক রূপকথার গল্প। একদম শূন্য হাতে শুরু করেছিলেন আবদুল জব্বার খান ও তার দল। তারপর শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তিল তিল করে নির্মাণ করেছেন অধরা সেই স্বপ্নকে। মুক্তি দেয়ার পর টানা চার সপ্তাহ হাউজফুল ছিল ‘মুখ ও মুখোশ’। সিনেমা আরও দীর্ঘদিন চলতো– কিন্তু হলের বুকিং ছিল চার সপ্তাহের জন্য বরাদ্দ। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে ‘আকাশ ও মাটি’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘জাগো হুয়া সভেরা’, ‘এদেশ তোমার আমার; ১৯৬০ সালে ‘রাজধানীর বুকে’ এবং ‘আসিয়া’ মুক্তি পেতে থাকে ক্রমে ক্রমে। ভেঙে যেতে থাকে বাধার সকল গণ্ডি। এরপর থেকে প্রতি বছরেই মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্র, চলছে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। ‘মুখ ও মুখোশ’ হল বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পের উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক। যতদিন বাংলাদেশের সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি থাকবে, ততদিন ধ্রুবতারার মতো প্রজ্বলিত থাকবে ‘মুখ ও মুখোশ’ এর নাম।